প্রকাশিত: Mon, Feb 20, 2023 4:35 PM
আপডেট: Wed, Jun 25, 2025 5:04 AM

ভাষা আন্দোলন, বাঙালির আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ভাষা আন্দোলন নিয়ে অনেক কথা আছে, অনেক কিছুই বলা হয়নি। প্রথমত ভাষা আন্দোলন শুধু বাঙালির ভাষার লড়াই ছিলো না। এই লড়াইটি ছিলো বাঙালির আত্মপরিচয়ের লড়াই। কারণ বাঙালির ভাষা বাংলা ভাষা। ভাষার লড়াইকে শুধু ভাষা আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছিলেন, উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হলে বাঙালি অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতো, তারা কোনো চাকরি-বাকরি পেতো না। পাশাপাশি তিনি আরও বলেছিলেন, ভাষা হারিয়ে গেলে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। 

ভাষা আন্দোলন যে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হরতালের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিলো তা বলা যায় না। ভাষা আন্দোলনের একটা দীর্ঘ পটভূমি আছে। ১৮৬৭ সালে বেনারসে হিন্দু নেতারা একটি সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ভারত স্বাধীন হলে রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। এর প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখি, মুসলমানদের মধ্যেও একটা দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। স্যার সৈয়দ আহমেদ তখন দিল্লির কমিশনার, আলেকজান্ডার শেক্সপিয়ারকে লিখলেন, যে এই ঘটনার পরে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায় আর এক হতে পারবে না। এক হতে পারেওনি। 

উর্দুকে কেন পাকিস্তানিরা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, সেটার অনেক কারণ আছে। একটি কারণ হচ্ছে উর্দু ভাষাকে আরবি হরফে লেখা। অর্থাৎ ইসলামি চেতনার সঙ্গে উর্দু জড়িয়ে আছে, এমনটি দেখানোর চেষ্টা করতো। উর্দু বা হিন্দি কোনোটাই ভাষা নয়Ñউপভাষা। মোঘল আমলে হিন্দুস্তানি ভাষা ছিলো। যা একটা খিচুড়ি ভাষা। মোঘলদের রাজত্ব শেষে ইংরেজদের রাজত্ব শুরু হলে ওই হিন্দুস্তানি ভাষা থেকে সব আরবি-ফার্সি ভাষা তুলে দিয়ে হিন্দি ভাষা হলো। আর উর্দু ভাষা সংস্কৃত, যার স্থানীয় ভাষা বাদ দিয়ে। বেনারসে ১৯৬৭ সালে যে সভাটি হয়েছিলো, সেই সভা থেকে ভাষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ও রাজনীতিকীকরণের সূচনা হয়েছিলো। ভাষার রাজনীতি উপমহাদেশে খুব একটা গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয় না। ভাষা দলীয়করণ, রাজনীতিকরণ এবং ধর্মীয়করণ করা হয়েছিলো।  

আমরা লক্ষ্য করি, বেনারস সভার পরে মুসলমানরা লিখতে শুরু করলো, বলতে শুরু করলো যে হিন্দুর ভাষা যদি হিন্দি হয়, তাহলে মুসলমানের ভাষা হবে উর্দু। উর্দু ভাষার পেছনে একটা ইসলামি চেতনা কাজ করেছে বলে আমি ইতোমধ্যেই বলেছি। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথও তেমন একটা বিশ^াস করতেন যে, স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত হিন্দি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তিনি নিজে উর্দুভাষী ছিলেন না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানতেন কিনা জানি না, বাঙালির ৯৮ শতাংশ উর্দু ভাষা বোঝে না। বাংলা বলতো পাকিস্তানের ৫৪ শতাংশ নাগরিক। ৬ দশকি শূন্য সাত ভাগ বলতোÑউর্দু। সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা কখনো একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। সাধারণত যে দেশের নাগরিকেরা যে ভাষায় গরিষ্ঠসংখ্যক কথা বলেন, সেটিই হয় রাষ্ট্রভাষা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও একপর্যায়ে বলেছিলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ইসলামী চেতনার সঙ্গে সহমত পোষণ করেই এই কাজটি করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ধর্মের রাজনীতি তিনিও করেছিলেন। কারণ তার পাকিস্তান সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেওয়াটাই ধর্মের রাজনীতিকীকরণের একটি দৃষ্টান্ত। 

ভাষা আন্দোলনের তারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে আমাদের মধ্যে। আমি যতোটুকু তথ্য পেয়েছি, তা থেকে বলবো, ১৯৪৮ সাল থেকে নয়, ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিলো ১৯৪৭ সাল থেকেই। সাতচল্লিশ থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার যুক্তিসংগত তথ্য আমাদের হাতে আছে। যেমন ধরা যাক ১৯৪৭ সালের ১৭ আস্ট শেখ মুজিবুর রহমান তখন ২৭ বছরের তরুণ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক মিল্লাত’ পত্রিকার সম্পদকের কক্ষে বসে আলোচনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। আরেকটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হয় গরিষ্ঠের মুখের ভাষাই। 

আবার একই সময়ে আলিগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের সেই সময়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন ইসলামী মানসিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। ড. জিয়াউদ্দিনের এই প্রস্তাবনাকে বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজাদ পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘যদি দুই প্রদেশের মধ্যে সংযোগ ভাষা হতে হয়, তাহলে বাংলা হতে হবে। অথবা ইংরেজি করুক। বিতর্কটা শুরু হয়ে গিয়েছিলো ঠিক ওই সময় থেকেই বলা যায়। এ কারণে বঙ্গবন্ধু ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ভাষা আন্দোলনের দ্রষ্টা হিসেবে বলি। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের স্রষ্টাও। কারণ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে তথ্যের ভিত্তিতে। 

বাঙালির স্বাধিকার চেতনা কতোটুকু আহুত করেছিলো ভাষার এই প্রসঙ্গটি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হলো ভাষা প্রশ্ন সামনে রেখে। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস প্রকাশ করেছিলো তাদের সেই সাড়া জাগানো পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’? ওই পুস্তিকা প্রকাশ হওয়ার পরই বুদ্ধিভিত্তিক জগতে ভাষার প্রশ্নে একটা আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো। ওই পুস্তিকায় যারা লিখেছিলেন, তাদের কথা যদি আমরা অনুসরণ করি, তাহলে আমার বিশ্লেষণে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্তত দুটি কারণ আমি খুঁজে পাই। একটি কারণ হচ্ছে মুসলমানী আবেগ। কারণ উর্দু ভাষা লেখা হতো আরবি হরফে। যা এখনো লেখা হয়। কাজেই উর্দু ভাষা আরবি হরফের সঙ্গে থাকার কারণে অনেকটা ইসলামলগ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। 

পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশির ভাষা ছিলো বাংলা। তবুও বাঙালির উপরে একধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেতনাও ছিলো উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ ও ২৪ মার্চ ঢাকায় যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর স্বপক্ষে কথা বলেছিলেন, তখন আমার মনে হয়, দুটি কারণে তিনি তা করেছিলেন। একটি হচ্ছে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইসলামকে রাজনীতিকীকরণ করেছিলেন পাকিস্তান হওয়া প্রসঙ্গেই। ফলে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি ইসলামী আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হলেন। আরেকটি তিনি দেখেছিলেন, উর্দু ভাষা যদি চাপিয়ে দেওয়া যায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তাহলে বাঙালিকে অনেকটা দুর্বল করা যাবে। মনে রাখতে হবে, বাঙালি যদি উর্দু ভাষায় কথা বলতো, তাহলে বাঙালি রাতারাতি একটা অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতো। তথ্য-উপাত্ত কিছু পেতো না। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছু হারিয়ে যেতো। 

এই কথাগুলো বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই বলেছিলেন ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনে এবং ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে। বাংলা ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার লড়াই ছিলো না, এটা ছিলো আমাদের আত্মঅধিকার আদায়ের লড়াই। আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। কাজেই বাঙালির বাঙালিত্ব খর্ব করার যে উদ্যোগ ছিলো রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে, বাঙালি তা রুখে দাঁড়িয়েছিলো। এই রুখে দাঁড়ানোটাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করার একটা বড় উদ্যোগ। সে কারণেই আমরা বলি, ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে। আর বাঙালি জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিলো ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। 

পরিচিতি : ইতিহাসবিদ