প্রকাশিত: Thu, Jan 11, 2024 12:28 AM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 1:58 PM

সংবিধানের বৈপরীত্য

জায়েদুল আহসান পিন্টু, ফেসবুক: সাংবিধানিক স্ববিরোধিতার নতুন উদাহরণ তৈরি হয়েছিল দশম ও একাদশ সংসদের সদস্যদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। দ্বাদশ সংসদের ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ তৈরি হতে চলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় সেটা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

বিতর্কের শুরু একটি সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদের সদস্যদের দায়িত্ব নেওয়া নিয়ে। সংসদ বহাল একটি আর সরকার গঠন হচ্ছে আরেকটি সংসদ সদস্যদের নিয়ে। 

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ এর  দফা ৩ এর ক উপ-দফায় বলা হয়েছে মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ একটি সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আরেকটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন হলে একই সময়ে দুটি সংসদের ৬০০ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান। এতে কোনো সাংবিধানিক ব্যতয় হয়নি। কারণ এই অনুচ্ছেদেই শর্ত দেওয়া হয়েছে উপ-দফা ক অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, বহাল সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করবেন না। 

কিন্তু দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দেখা গেছে, নির্বাচিতরা আগের সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শপথ নিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা মন্ত্রী হিসেবেও শপথ নিয়েছেন। এমনকি আগের সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীও নতুন করে শপথ নিয়েছেন। আর শপথ নেওয়া মানেই কার্যভার গ্রহণ করা। কারণ অনুচ্ছেদ ১৪৮ এর (৩) অনুযায়ী 'এই সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।' তার মানে অনুচ্ছেদ ১২৩-এ যে শর্ত দেওয়া হয়েছে নবনির্বাচিতরা কার্যভার গ্রহণ করবেন না, সেটা আদৌ কার্যকর নয়। একই রকম সাংবিধানিক ব্যতয় ঘটেছে নবম সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় দশম সংসদে নির্বাচিতদের শপথ নেওয়ার পর। 

এখানে সাংবিধানিক ব্যাখা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। দুটি সংসদ নির্বাচনের পর আগের সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রিসভা গঠন, মন্ত্রিসভার বৈঠক করা স্পষ্টতই স্ববিরোধী। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন দশম সংসদের মেয়াদ ছিল ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত। কারণ দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২৯ জানুয়ারি ২০১৪ সালে। সংবিধানের ৭২ এর ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।" রাষ্ট্রপতি যেহেতু সংসদ ভেঙ্গে দেননি তাই দশম সংসদ ২৮ জানুয়ারি ভেঙ্গে যাবে। 

একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। নির্বাচনে বিজয়ীরা শপথ নিয়েছেন ৩ জানুয়ারি। আর মন্ত্রিসভা শপথ নিযেছে ৭ জানুয়ারি। এরপর থেকে মন্ত্রীরা দায়িত্ব পালনও শুরু করেছেন। প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক যে, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ থাকলে ওই সংসদের সদস্যদেরও মেয়াদ থাকবে। মন্ত্রিসভা গঠনের পরপরই আগের সরকার বাতিল হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সংসদ বাতিল হতে পারে না। সংসদ বাতিলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও রাষ্ট্রপতির আদেশ প্রয়োজন। নবম ও দশম সংসদ ভাঙ্গার কোনো আদেশ দেওয়া হয়নি। তার মানে ওই দুটি সংসদ বহাল ধরে নিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। সংসদ যে বহাল সেটা অধিবেশন আহ্বান করার ক্ষেত্রে আবার অনুসরণ করা হয়েছে। কারণ একাদশ সংসদ আহ্বান করা হয়েছে ৩০ জানুয়ারি। ২৯ জানুয়ারির আগে ডাকা হয়নি। তেমনি দশম সংসদও আহ্বান করা হয়েছিল নবম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর। যদিও সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়ে কার্যভার আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন।

এবারও আগের গোজামিলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। আশা করি কোন না কোন সময় সর্বোচ্চ আদালত থেকে এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

(লেখাটি কয়েক বছর আগে প্রকাশিত আমার 'সংবিধানের বৈপরীত্য' প্রবন্ধের অংশবিশেষ।)