প্রকাশিত: Tue, Jan 17, 2023 1:27 PM
আপডেট: Sun, Jun 8, 2025 7:49 AM

শিক্ষা ব্যবস্থা রক্ষায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মতো বেগবান করে তোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই

হেলাল মহিউদ্দীন

ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইতে সমাজপাঠ অংশে ইতিহাস বর্ণনার যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি ভুল মনে করি। ভুল নম্বর এক. প্রায়োরিটিতে থাকার কথা ক) সামাজিক পরিবেশ, মানুষ ও জগতসমাজের সম্পর্ক। খ) প্রাকৃতিক পরিবেশ, ক্ষয়, বিনাশ, রক্ষা ইত্যাদি। গ) সাংস্কৃতিক পরিবেশ, বিশ্ব সংস্কৃতি, মানবিকতা, জেন্ডার ইক্যুইটি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সমতা এবং ঘ) রাজনৈতিক পরিবেশ তথা রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, নাগরিক, অধিকার-কর্তব্য, আইন-বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ইতিহাস হতে উদাহরণ দেওয়া পর্যন্তই ইতিহাসের গন্ডি নির্ধারিত হওয়া দরকার ছিল। কৌতূহল বা আরো জানার আগ্রহ তৈরি করাই মাধ্যমিক শ্রেণির উঠতি কৈশোরের মূল শিক্ষা-লক্ষ্য হওয়া দরকার। এই বয়েসীদের জন্য ইতিহাস শেখানোর বিষয় নয়। ইতিহাস কৌতূহল জাগানো ও বিচার-বিশ্লেষণে হাতেখড়ি দেবার মাধ্যম।     

ভুল নম্বর দুই : ‘ইতিহাস’ মারাত্মক বিপর্যয়কর ও বিপজ্জনক বিষয়। যে যখন ক্ষমতায় আসে ও থাকে, সেই তার মতো করে ইতিহাস লেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এই সত্য পৃথিবীর সকল দেশের বেলায় সত্য। পাকিস্তানিরা তাদের পাঠ্যপুস্তকে একাত্তর সালকে এড়িয়ে যায়। ঠেকায় পড়লে বড়জোর বলে ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধ। ভারতেরও একই সমস্যা। বাংলাদেশকে ক্রেডিট দেওয়া যাবে না। তাই লেখা থাকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’। আবার ধরুন, বাংলাদেশের জন্য গ্লানিকর হাইড্রোইলেক্ট্রিসিটি প্ল্যন্টজনিত রাজনৈতিক সমস্যা। প্ল্যান্ট করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমি জলমগ্ন করা হলো। জুম্ম জনগোষ্ঠীকে গৃহহীন করা হলো। বহু আগে। তারপর বাংলাদেশের শাসনকালগুলোও বিতর্ক বাড়াল। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্ত্ক প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রেও এসব সত্য সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, স্প্যানিয়ার্ডদের জন্য গ্লানিকর অধ্যায় ছিল অন্যের দেশ দখল করতে গিয়ে লুণ্ঠন ও নিষ্ঠুর গণনিধন। তাই তারা তাদের ইতিহাসে বানিয়ে বানিয়ে লিখত অন্যের জমি দখল করতে নয়, সম্পদ লুট করতে নয়, তারা গিয়েছিল বর্বর অসভ্য নেংটি পরাদের সভ্য করার জন্য। ধর্মের বাণী, জ্ঞানের বাণীতে আলোকিত মানুষ বানানোর জন্য। মিথ্যা কথা যদিও! এসব মিথ্যে কখনো টেকেনি। কখনোই টেকে না। মানুষ খুঁচিয়ে সত্য আবিস্কার করে ফেলে।তাহলে ভুল পদ্ধতিটি কোথায়? 

ভুল নম্বর তিন : সমাজবিজ্ঞানের মূল পদ্ধতি সম্পূর্ণ ‘ভ্যাল্যু-ফ্রি’ ও ‘জাজমেন্টালিটি-ফ্রি’ থাকা। খুব সহজ করে বললে ‘উচিত-অনুচিত’, ‘ঠিক- বেঠিক’, ‘ভালো-মন্দ’ মানদণ্ডে মূল্যায়ন না করা তো বটেই, বাক্য এমনভাবে লেখা যাতে তথ্য থাকবে বটে, কিন্তু কোনো একটা মত-পথ বা বিশ্বাসের দিকে ধারণা ঝুঁকে পড়বে না। কারণ সামাজিক ইতিহাসে বেশির ভাগ বিতর্কই সুরাহা-বর্জিত। নতুন পাঠ্যবইয়ে অনেকগুলো বয়ান ও বাক্যই দেখেছি ভ্যাল্যু-ফ্রি নীতিমালা মানেনি। লেখকদের জানাটিই যেন সঠিক ধারণা-এমনভাবে অন্যদের জন্য জ্ঞান হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। ভুল নম্বর চার : মন্দির ভাঙা ধ্বংস করার তথ্য নিতান্তই বেদরকারি ছিল। কারণ অনেক। এই সময়ে মসজিদ-মন্দির যেহেতু রাজনীতি ও ঘৃণার কৌশল, তখন প্রসঙ্গটি বা শব্দটিকে কাছেই ঘেঁষতে দেওয়া ঠিক হয়নি। বড় হয়ে ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসুগণ তথ্য ছেঁকেই না হয় আসল সত্য জানবেন। কিছু কিছু অপেক্ষা ভালো এবং দরকারি। মন্দির বিতর্কটি এখনো চলমান এবং এখনো সিদ্ধান্ত মেলেনি। পশ্চিমা তো বটেই, ভারতীয় ঐতিহাসিকদের একদলও লিখেছেন, মন্দির জেনে নয়, দুর্গ ভেবেই সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেন। মাহমুদের পরাজিত শত্রুরা সোমনাথে আশ্রয় নিয়ে ফের যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হচ্ছিল। তাদের ঠেকাতে আক্রমণ। আরএসএস বিজেপির প্রতিষ্ঠিত ভাষ্য ৬০০০০ মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। ঈটন-এর ভাষ্যমতে, ৮০টি। বার্নিয়ে্যঁ, ঈটন, অড্রে ট্র্যুস্কদের বিচারে ‘মিথ’ বা কল্পকাহিনী। রিচার্ড ডেভিড ‘ইন্ডিয়ান আর্ট অব্জেক্টস অ্যাজ লুট’ প্রবন্ধে জানালেন ক্ষমতাধর হিন্দু রাজা-মহারাজারাই বেশির ভাগ মন্দির লুট করেছে। দামি কষ্টিপাথর বা আকরিকের মূর্তি ও মূল্যবান শিল্পকর্ম তাদের কাছে শিল্প। বৈঠকখানার শোভা (মুসলমানদের কাছে হারাম ও শিরক, এবং পরিত্যাজ্য)। 

মন্দির প্রসঙ্গটি টানা একটি অ-ঠিক ইতিহাস-লিখন পদ্ধতি হয়েছে। যুদ্ধবাজি ও লুন্ঠনের অবধারিত অংগ স্থাপনা ধ্বংস। এখনো সিরিয়া আর ইয়েমেনে যুদ্ধে গোলার আঘাতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মসজিদের মিনার-মিম্বার ধ্বসে পড়ে। মসজিদের দানবাক্স ভেঙে টাকাপয়সা লুণ্ঠন হয়। ধর্মগ্রন্থের একটির উপর অপরটি বসিয়ে স্তূপ বানিয়ে উপরে চড়ে মসজিদের ঘড়িও চুরি হয়। মুসলমান আতাতুর্কও বহু মসজিদকে শপিং মল বানিয়ে ফেলেছিলেন।

[২] পিনাকি ভট্টাচার্য শিক্ষা বিষয়ে কী আলাপ তুলেছেন দেখলাম ও বুঝার চেষ্টা করলাম। তিনি ‘র’-এর লোক না সিআই-এর লোক আলোচনাও দেখলাম। তাঁর উদ্দেশ্য-বিধেয় কী, রাজনীতি না প্রোপাগান্ডা এসব বাহাসের দিকে আলাপ মোড় নেবার অনেক বিপদ। লাভের চাইতে ক্ষতি বেশি। পথ পাবার বদলে হারানোর সম্ভাবনা বেশি। পিনাকি ভট্টাচার্য’র ন্যারেটিভকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রেখেই একটি সত্য নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন ভীষণ দরকার। ঝড়ের বেগে শুরু হওয়া দরকার। স্কুল-কলেজে অটোপাসে শিক্ষা বরবাদ। শিক্ষায় অগ্রগতি দেখাতে গিয়ে নব্বই ভাগ স্কুলে পাস করিয়ে দেবার নির্দেশনায় শিক্ষা আইসিইউতে। বাপ-দাদা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নামে রাজনীতিকদের পান-বিড়ির দোকানের মতো স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা খোলায় শিক্ষার ধরন যাচ্ছেতাই। সরকারি টাকায় ভাগ বসানোর, এমপিওভুক্তির রাজনীতির কারণে যারা বিএ, এমএ করে বেরোচ্ছে, তাদের অনেকেরই পঞ্চম শ্রেণি পাসের যোগ্যতাও আছে কিনা সন্দেহ হয়। এই সংক্রান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লেখাটির শেষে লিখবো। 

[৩] পিনাকি ভট্টাচার্যের ‘হিন্দুত্ববাদ’ ন্যারেটিভটি বিপজ্জনক। অহিন্দু ধার্মিকদের মধ্যেকার অতি-সংবেদনশীল অংশের গা গরম করে দিলে পারস্পরিক ধর্মবিদ্বেষ বাড়তে পারে, সংঘাত বাড়বে বটে, শিক্ষার সংস্কার বা শিক্ষা ব্যবস্থার উপকার কিছুই হবে না। পাঠক্রম হিন্দুত্ববাদী হলেও যা ইসলামত্ববাদী হলেও তা-ই। একই লাউ, একই কদু। ইতিহাস পাঠের বেলায় স্কুল পর্যায়ের এসব বাদানুবাদ টেকসই কোনো কিছু নয়। এই সময়ে যখন বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এসএসসির অ্যাব্রিভিয়েশনই জানে না, তারা বিভিন্ন সন, যুগ, পর্ব, শাসনকাল আদৌ মনে রাখবে কী না সন্দেহ। ভাল ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে নিজেদের বিশ্লেষণী সক্ষমতা দিয়েই সত্যমিথ্যা জেনে নেবে। আমরা যেমন স্কুলে কী জেনেছি না জেনেছি মনে নেই, তবে বড় হয়ে জটিলতাগুলো ধরতে পারছিÑসে রকম! 

[৪] বিতর্ক উস্কানো ইতিহাস-চর্চার চাইতে বেশি প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থার ক্যান্সারমুক্তি। নির্দেশনার পাস সার্টিফিকেটধারীরা দেশটাকে কয়েকশ হাজার কোটি টাকার রমরমা ঘুষ-দুর্নীতির বাজার বানিয়ে ফেলছে। যেহেতু জানে কাগজটি ছাড়া কোনো শিক্ষা-দীক্ষা তাদের আসলে নেই, তারা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ঘুষ দিয়ে চাকরি কেনে। তারপর কয়েক মাসেই পুঁজি তুলে ফেলে। বাকি জীবন বাণিজ্যলক্ষ্মীর পদতলে কাটে। এমএ পাস একজনের আহাজারিতে মন নরম হয়েছিল। তার চাকরি মিলছে না। চাকরি পেতে দশ লাখ টাকা ঘুষ লাগবে। কিছু অর্থসহায়তা দরকার। তদ্বির-সহায়তাও দরকার। নিয়োগকর্তা নাকি আমার ছাত্র ছিল একসময়। মারাত্মক গবেষণা! বললাম, একটি বাংলা প্যারাগ্রাফ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে। আরেকটি ইংরেজি প্যারাগ্রাফ বাংলায় অনুবাদ করতে। বলেছিলাম, পরীক্ষাটিতে পাস করলে তার চাকরির দাবিতে সশরীর আন্দোলনে নামব। তদ্বির-ফদ্বিরের কথা যেন ভুলেও মুখে না তোলে। ফলাফল? আর কিচ্ছু লিখব না। আকল্মান্দ-এর জন্য ইশারাই। শিক্ষা ব্যবস্থা রক্ষার আন্দোলনকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মতো বেগবান করে তোলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। লেখক: শিক্ষক ফেসবুক থেকে