প্রকাশিত: Fri, Jan 20, 2023 10:19 AM
আপডেট: Sat, May 10, 2025 4:31 PM

প্রাণের পরে চলে গেলো কে

অজয় দাশগুপ্ত 

পুরুষ কেবল নারীর প্রেমে পড়বে। এটাই দস্তুর। শরীরমুখ্য প্রেমের এটাই নিয়ম। কিন্তু এর বাইরেও প্রেম থাকে। যেমন অকপটে বলি, সৌমিত্রের প্রেমে পড়া আমার জন্য ছিলো গৌরবের। সে কবে প্রথম নাম শুনেছিলাম। যখন কবিতা লেখার শুরু, সে সময় শিল্প সাহিত্যের একখানা বনেদী ম্যাগাজিন এসেছিল হাতে। যার নাম ছিলো, এক্ষণ। এই এক্ষণের একজন সম্পাদক ছিলেন নির্মাল্য  আচার্য আর একজন ইনি। অভিজাত ম্যাগাজিনটি ছিলো তাঁর কাব্যও সাহিত্য প্রেমের দলিল। এর মাধ্যমে আমি প্রথম শ্রীমা মাদার রীশার নাম জানি। পড়ি জন্ম বোহেমিয়ান হামদি বে’র কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল লেখকদের এক জায়গায় এনেছিলেন এই দুই সম্পাদক।

অন্যদিকে তিনি তখন মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্রে ব্যাপক পদচারণায় ব্যস্ত। নায়কও ছিলেন। যারা অভিনয় করতে জানেন তাঁরাই তো অভিনেতা। কিন্তু এর মাঝখানে আবার কথিত সুন্দর চেহারার দু’জন ঢুকে থাকে। যাদের নাম  নায়কও নায়িকা। ভাগ্যিস তিনি নায়ক হিসেবে ততটা সফল হননি। তাহলে বাঙালি এতবড় একজন অভিনেতা পেতো? যিনি মধ্য আশিতেও অভিনয়ে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলা বাঙালির অহংকার সত্যজিত রায়ের ছবিতে নিয়মিত ছিলেন তিনি। বাঙালির জীবনে অপু ও  দুর্গা দুই অভিন্ন অনুপম চরিত্র। ইনিই সে অপু। বিভূতিভূষণের অসাধারণ বাংলার অপরাজেয় নায়ক।

সত্যজিতের একেকটি ছবিতে একেক ধরনের মহিমায় উদ্ভাসিত অভিনেতা  ভারতের দাদা ভাই ফালকে  পুরস্কার ও পদ্মভূষণ উপাধি এনে দিয়েছেন বাঙালিকে। শুধু কি তাই? ফরাসি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাবও পেয়েছেন অবদানের জন্য। কী অসাধারণ কণ্ঠ তাঁর। রবীন্দ্রনাথের কবিতা হয়ে ওঠে জীবন্ত। জলদগম্ভীর বলে যে শব্দ তার সবটাই মূর্ত তাঁর স্বরে।যত বয়স বেড়েছে ততো আরো পরিণত আরো মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। এই সে দিন ময়ূরাক্ষী নামে এক ছায়াছবিতে স্মৃতিভ্রম এক পিতার চরিত্রে অভিনয় করলেন। সারারাত কষ্ট বুকে জাগিয়ে রাখার মতো অভিনয়। তাঁর নাম দেখলেই আমার মতো অনেকে সে ছবিটি একবার হলেও দেখতে ভালোবাসেন। কারণ তিনি মানেই যে নতুন কিছু নতুন কোন অবলোকন।

সব মিলিয়ে এক চমৎকার বহুমুখী প্রতিভার বাঙালি। এত অর্জন, এত নাম, এত ব্যপ্তির পরও বিনয়ী, ভদ্রলোক। যতদিন তিনি  ছিলেন ততোদিন আমার মতো অনেকের কাছে সিনেমা ও অভিনয় ছিলো নবীণ পাতার মতো। নতুন কোনো তারার মতো জ্বলজ্বলে। শেষ যাত্রায় যিনি প্রথাগত ধর্মীয় কিতাবের বাইরে গীতবিতান আর সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল সাথে নিয়ে যেতে চান তাঁকে মানুষ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারবো না। আর এই মানুষেরই সাধনা করেছিলেন বাউল ফকির দর্শনের মানুষজন। বাঙালির সৌভাগ্য ছিলো তাঁকে পাওয়া।  আজ আপনি নাই। জন্মদিনে (১৯ জানুয়ারি) প্রণাম জানাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাই ধার করছি: আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে বসন্তের ঐ বাতাস টুকুর মতো/শুভ জন্মদিন চিরজীবী সৌমিত্র। প্রণাম। লেখক ও কলামিস্ট