প্রকাশিত: Sat, Jan 21, 2023 3:02 PM
আপডেট: Sat, Jun 28, 2025 3:17 PM

ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত, গণতন্ত্রের মডেল এবং জনগণ

কাজী এম মোরশেদ

গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসির সূচনা প্রাচীন গ্রীসে। রাজ্য চলতো সীজারদের অধীনে, সেখানে সিনেট ব্যবস্থায় এলাকা অনুযায়ী প্রতিনিধি থাকতো। এই সিনেটরদের বক্তব্য এলাকার জনগণের বক্তব্য, সেটাকেই তুলে ধরতো। গণতন্ত্র মানেই জনগনের কথা। জনগণ রাষ্ট্রের মালিক, শাসক শ্রেণী সেই মালিকদের ইচ্ছার প্রতিফলন সিনেটরদের মাধ্যমে তুলে ধরতো। আব্রাহাম লিংকনের সেই বাণী সরকার, জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণ থেকেÑ এই বাণী সেই গণতন্ত্রের প্রতিফলন। যেই দেশেই প্রকৃত গণতন্ত্র আছে, সেখানেই দলবাজির ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্র প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত বা গণতন্ত্রের মডেল আমেরিকা বা গণতন্ত্রের ঝান্ডাধারী যুক্তরাজ্য যাই ধরেন, এখানেও প্রকৃত গণতন্ত্র যা সেই প্রাচীন গ্রীসে ছিলো এখন আর নাই। সেই দলবাজি করে চার বা পাঁচ বছরে একবার ভোট এর বাইরে কোনো গণতন্ত্র পাবেন না। স্যার চার্চিলকে জিজ্ঞাস করা হয়েছিলো গণতন্ত্রই কি শ্রেষ্ঠ মাধ্যম? উনার জবাব ছিলো, না তবে অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে এটা ভালো। টোরি বনাম লেবার, আমেরিকার রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্রেট সব দেশই জনগনের উপরে দলের প্রাধান্য তুলে ধরে। 

গত বেশ কয়েক বছর ধরেই যেই দেশ প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছে সেটা সুইজারল্যান্ড। এখানে প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রিসভা নিয়ে কোনো চিন্তা নাই। এখানে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ মূল কথা। কয়েক ধাপে পৌছাতে হয়েছে, এইজন্য এর নাম দিয়েছে মডার্ন ডিরেক্ট ডেমোক্রেসি। দেশ চালায় মূলত সাতজন ব্যক্তি, এরমধ্যে একজন প্রধান থাকেন, অনেকটা প্রেসিডেন্ট ধরনের। বাদবাকি সকল ডিসিশন যা নেওয়া হয় সবই জনগণের ভোটে। 

ক্ষমতার কেন্দ্রে এই জনগণ। সরকারের কাজ জনগণের সেবা করা, জনগণ যা চাইবে তাই হবে। এখানে বছরে কম করে ১০০-১২০টা রেফারেন্ডাম হয়, যেটা হ্যাঁ না ভোটের মতো। জনগণ সরাসরি অংশ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত সরকার মানতে বাধ্য। তারা যেই ধাপ অনুসরণ করেছিলো, প্রথম পর্যায়ে শিক্ষা, দ্বিতীয় পর্যায়ে টেকনোলজি, তৃতীয় পর্যায়ে রেফারেন্ডাম। গৎবাধা গণতন্ত্রে ২০০ টাকা নিয়ে অশিক্ষিত একজনের ভোটের সংখ্যা এক, তেমনি অতিশিক্ষিতের ভোটের সংখ্যা এক। জনগণের সবাই সমান অধিকার গণতন্ত্র হলে মডার্ন কি হলো? মডার্ন এটাই সবাই শিক্ষিত, এবং ভোটের মান সমান। 

ডিরেক্ট ডেমোক্রেসি যেজন্য, জনগণ দুইধাপেই সরকার পর্যন্ত পৌছাতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ, টেকনোলজি ব্যবহারে কিছু বলা। এতে যদি সরকার উত্তর না দেয়, দ্বিতীয় ধাপে সিটি কাউন্সিলে হাজির হওয়া। জনগণের এই যাওয়া কেউ বন্ধ করতে পারবে না, সিটি কাউন্সিল শুনতে বাধ্য। বাংলাদেশের কনটেক্সট চিন্তা করেন, আপনার এলাকার সংসদের কাছে আপনি পৌঁছাতে পেরেছেন? আপনার সংসদ সদস্য আপনার এলাকার কথা সংসদে বলেন? সংসদে ভোট হলে আপনার এমপি কি দলের বাইরে গিয়ে আপনার কথা মেনে ভোট দিতে পারেন? উত্তর না হলে বাংলাদেশে কীসের গণতন্ত্রের চর্চা হয় সেটা বুঝবেন। আমাদের দায়িত্বশীল ক্ষমতাবানরা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলেন, আমরা শুনেই যাই। 

জনগণকে ডিরেক্ট ডেমোক্রেসিতে যুক্ত করার একটাই রাস্তা, রেফারেন্ডাম। এই হ্যাঁ-না ভোট সবচেয়ে কার্যকর। ২০০৫ সালে এসতোনিয়া প্রথম এই-ভোট শুরু করে, ইন্টারনেট ভোটিংয়ের মাধ্যমে জনগণের হ্যাঁ-না ভোট দিতে কোনো কেন্দ্রে যেতে হয় না, সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ডের বাইরে একটা ভোটের কার্ড, নম্বর এবং পাসওয়ার্ড থাকে। কারো জানার দরকার নাই ভোট বাসা বা অফিস বা মোবাইল বা বিদেশে বসে দিচ্ছে। রাস্তায় মিছিল নাই, আন্দোলন করে সরকার পতন নাই। 

দেশের সমস্ত ডিসিশন মডার্ন ডিরেক্ট ডেমোক্রেসির মাধ্যমে চলছে। ধরেন যুক্তরাজ্যে পাইলটদের ধর্মঘট বা ফ্রান্সে রেলকর্মীদের ধর্মঘট শুনবেন। শিষ্টাচারের দেশ সিঙ্গাপুরে শিক্ষকরা রাস্তার পাশে প্লাকার্ড নিয়েছিলো। সরকার চারঘণ্টার মধ্যে বেতন বাড়াতে বাধ্য হয়। যুক্তরাজ্যের নিয়ম অনুয়ায়ী কোনো ইস্যুতে একটা পিটিশন পরলে একলাখ মানুষ সই করলে সেটা নিয়ে হাউজ অফ কমন্সে বাধ্যতামূলক আলোচনা হতে হয়। আমাদের কথা চিন্তা করেন, রাস্তায় বিরোধি দল একটা মিছিল ডাকলে পুলিশের লাঠির বাড়ি আছে, সাথে বোনাস হিসাবে মামলা আছে। আর এর উপরে সরকারি দলের নেতা কর্মীরা ঘোষণা দেয় জনগণের জানমাল পাহারা দিতে তারা রাস্তায় থাকবে। এইটা গণতন্ত্রের কোন মডেল? যেখানে জানমালের নিরাপত্তা পুলিশ দেবে, সেখানে একটা দল ঘোষণা দেয় কীভাবে? 

ইউরোপ বা আমেরিকায় মিছিল হয়। টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, তারপরও কারন আছে। ব্লাক লাইভ ম্যাটারস এরমতো ইস্যু আসলে বা ইয়েলোভেস্ট আন্দোলন, বা মাহশা আমিনি কেন্দ্রিক সকল মানবাধিকার ইস্যুতেই জনগণ রাস্তায় নামে। আমাদের টকশোগুলো দেখেন, সরকারি দল এবং সাংবাদিকরা যখন বলতে থাকেন আন্দোলন করে সফল হয়ে দেখান কি পারেন, এটা সরাসরি কনফ্রনটেশনের আহ্বান জানানো। যতোক্ষণ ভাঙচুর না করবেন বা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট প্যালেস, পার্লামেন্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে হামলা না করবেন আপনার জোর দেখাতে পারবেন না। 

গণতন্ত্র মানসিকতার ব্যাপার, এটা জোরাজুরির না, পুলিশ দিয়ে শায়েস্তা করা না, কোর্ট থেকে জামিন না দেওয়া না। জনগণ যা চাইবে তা হবে। রেফারেন্ডামের মতো এতো শক্ত একটা অস্ত্র বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের ইচ্ছায় বাতিল হয়ে গেলো। সাথে তত্ত্বাবধাক সরকার ব্যবস্থাও গেলো। আইনবিভাগের নীচ আদালত বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়ার ইচ্ছায় আইন মন্ত্রণালয়ে চলে গেলো। এইটা গণতন্ত্র হত্যার একেক ধাপ, আমরা গত কয়েক বছরে নিজেরাই করেছি। 

যেকোনো ইস্যুতে সরকারকে দিয়ে কাজ করানো, জনগণের সার্থে, সেটাই গণতন্ত্র। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে গেলে জনগণের প্রতিনিধিত্বে গণশুনানী হতো, ডিসেম্বরে সরকার এটা নিজের হাতে নিয়ে এখন ৫% দাম বাড়িয়েছে। ক্ষমতা যত বিকেন্দ্রীকরণ করে জনগণের হাতে পৌঁছায়, সেটি গণতন্ত্র। আমাদের গণতন্ত্র পুরোই এর উল্টো, যত সম্ভব কেন্দ্রীভূত করা। তারপরও আমরা একে গণতন্ত্র বলতেই থাকবো। উদাহরণ অনেক দিতে পারি, লাভ নাই। ধরেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কিনা, তার জন্য বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক কে? পুরো বিষয় জনগণের হাতে ছাড়লে সমস্যা কি ছিলো? অথবা রেফারেন্ডাম থাকবে কি না সেটার জন্য রেফারেন্ডাম করে হ্যাঁ-না ভোট করলে সমস্যা কি ছিলো? কোনো সমস্যা ছিলো না, শুধু একব্যক্তির হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতো না। এই কেন্দ্রীভূতের সমস্যাও দেখেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে সব মাফ, এরপর নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কিনলেও সমস্যা নাই। একটা রেফারেন্ডাম করে ইভিএম হবে কিনা জানতে চাওয়া যায়। তেমনি অনেক কিছুই রেফারেন্ডামে আনা যায়। দেশের ক্ষমতার অংশীদার পুরোপুরি জনগণ, দেশ ভুল করলেও সেটা জনগণের ভুল, ঠিক করলেও জনগণের ঠিক। আমার বাসার সামনের রাস্তায় ময়লা থাকলে আমাকে কেন ওয়ার্ড কমিশনারকে চিনতে হবে, কেন মেয়রকে চিনতে হবে? কেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো আমলা বা মন্ত্রীকে চিনতে হবে? অনলাইনে জানতে চাইবো কখন পরিষ্কার হবে, না হলে কমিশনারের দফতরে হাজির হয়ে জিজ্ঞাস করবো। তার উত্তর দিতে বাধ্য থাকবে। এটাই মডার্ন ডিরেক্ট ডেমোক্রেসি। 

আমি উইকিপিডিয়া দেখছি না, আপনিও দেখেন না, বলেন সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কে জানেন? কতজনের পার্লামেন্ট জানেন? কিছুই বলতে পারবেন না। যখন দেখবেন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত নেই, তখনই বুঝবেন সব ঠিকমতো চলছে, গণতন্ত্রের মডেলে জনগণই দেশের জন্য সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ফেসবুক থেকে