প্রকাশিত: Sat, Jan 21, 2023 3:09 PM
আপডেট: Sat, Jun 28, 2025 12:09 PM

পেশাগত জীবনে এগিয়ে যেতে যা করবেন, যা করবেন না

গুলজার হোসেন উজ্জ্বল

লেখাপড়া শেষ করার পর ডাক্তারদের পেশাগত জীবন শুরু হয়। ছাত্রজীবনে মাঝারি মানের ছাত্র হলেও অনেকে পেশাগত জীবনে এসে খুব ভালো করে। আবার অনেকেই ছাত্রজীবনে দুর্দান্ত ছাত্র হয়েও পেশাগত জীবনে অতটা ভালো করতে পারে না। কেউ কেউ দোষ দেন তার কর্মক্ষেত্র বা ক্যারিয়ার ডোমেইনটাই ঠিক নেই বলে। কেউ কেউ মনে করেন এই দেশটা সমাজটা ঠিক জায়গায় নেই, তাই তার মূল্যায়ন হচ্ছে না। পেশাগত জীবনে ভালো করতে হলে কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হয়। প্রথমেই যেটা করতে হবে সেটা হলো নেগেটিভিটি ছাড়তে হবে। ‘না’ বলার অভ্যাস কমাতে হবে। ঠিক যেখানে ‘না’ না বললেই নয়, সেখানেই বলতে হবে। লেগে থাকার মানসিকতা থাকতে হবে। ডাক্তারি পেশা একটি লম্বা রেইস। এখানে শর্টকাট নেই। থাকলেও সেই পথে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না। তাই লেগে থাকা এবং লেগে থাকাই একমাত্র মোটিভেশন। ৩৫ থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত আপনাকে যুদ্ধ করতে হবে। 

এ ভালো না, অমুকে খারাপ, তমুকে দুই নাম্বার এসব নিয়ে চর্চা বন্ধ করতে হবে। অন্যের সার্টিফিকেট দেওয়া আপনার কাজ নয়। অন্যদের সাথে নিজের তুলনা করবেন না। সবাই একইরকম মেধাবী নন। একেকজনের এক্সিলেন্স একেকরকম। তাই নিজের মতো করেই যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হবে। কারো পাঁচ বছরে হবে, কারো হবে দশ বছরে। সমস্যা কী? লক্ষে পৌঁছাতে পারলেই হলো। কে জানে পরের পাঁচ বছরে কার কেমন অর্জন হবে? পেশার ক্ষেত্রে নিবেদিত হতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। যে কাজটি করছেন সেটা ভুল হচ্ছে নাকি ঠিক হচ্ছে সেটা নিজের মত করে মূল্যায়ন করবেন। জনে জনে মতামত নেবেন না। কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববেন না। কাউকে টেনে নামানোর চেষ্টা করবেন না। দরকারও নেই। এতে অনেক বেশি জীবনীশক্তি ও প্রতিভার অপচয় হয়। এই ইফোর্ট নিজের দক্ষতা বাড়াতে কাজে লাগান। দ্বিগুন লাভবান হবেন। টক্সিক এটিচ্যুড  ত্যাগ করতে হবে। সুন্দরভাবে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।পরিশ্রমের মানসিকতা  থাকতে হবে। ‘কত কম কাজ করে কর্মঘণ্টা পার করা যায়’Ñ এই মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। এই মানসিকতা দিয়ে আটপৌরে জীবন যাপন করা যাবে, খুব ভালো করা যাবে না। সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতার মানসিকতা থাকতে হবে। আপনার আচরণে কেউ যেন আঘাত না পায় সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। সারাক্ষণ অন্যকে অপমান, তীর্যক বাক্য বলে অন্যদের ধরাশায়ী করতে চাওয়া খুব খারাপ অভ্যাস। এই ধরনের মানুষ জীবনে খুব ভালো কিছু  করতে পারে না। ভালো সহকর্মী হওয়াটাও ভালো পেশাজীবী হবার একটি ধাপ। কিছু সহকর্মী টক্সিক থাকেন। তাদের ইগ্নোর করতে শিখতে হবে। হা-হুতাশ করবেন না। মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। পাওয়ারও শেষ নেই। নিজের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন। অসন্তুষ্ট মানুষ মাত্রেই হতাশ মানুষ। হতাশ মানুষের আশেপাশে অন্যরা থাকতে পছন্দ করে না। হতাশ মানুষের  লিডারশিপ কোয়ালিটি ভালো হয় না। ক্লায়েন্টরাও  সার্ভিস পায় না। হতাশ ডাক্তাররা চেম্বারে রোগী পায় না। আরো হতাশ হয়। হতাশা একটা চক্রের মতো। 

সব জায়গায়  টাকাপয়সার হিসেব করবেন না। সব কাজ টাকার জন্যও করবেন না। কিছু কাজ করবেন নিজের সন্তুষ্টি ও কমিউনিটি পারপাজে। কিছু কাজ করবেন নিজেকে ছড়িয়ে দিতে। যারা প্রতিটি কাজে আর্থিক প্রাপ্তির হিসেব করে তারা বেশি দূর আগাতে পারেন না। যেকোনো চ্যারিটেবল কাজ আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ। পাঁচ-দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান সে হিসেবটা ঠিক করে রাখবেন। অন্যেরা আপনাকে কিছু করে দেবে এই আশায় থাকবেন না। স্যার, বস, বড় ভাই, চাচা, খালু এরা ফেভার করে আপনার উন্নতির মইটি এগিয়ে দেবে এরকম আশায় থাকবেন না। নিজের উপরেই ভরসা রাখতে হবে। নিজের কাজের ভেতর দিয়েই কমিউনিকেশন বাড়াতে হবে। কমিউনিকেশনের স্কিলও বাড়াতে হবে। নেটওয়ার্ক বড় করবেন। যার যত বড় নেটওয়ার্ক সে তত বেশি সাফল্য পাবেন। চ্যালেঞ্জ নেবার মানসিকতা থাকতে হবে। কোন ফিল্ডে কাজের সুযোগ কম বলে হতাশ হবেন না। মনে রাখবেন যেখানে কাজের সুযোগ কম সেখানে অন্য অর্থে অপার সম্ভাবনা। কারণ নতুন ফিল্ডেই নিজেকে মেলে ধরা সহজ। তবে এটি একধরনের যুদ্ধও। চ্যালেঞ্জ নেবার মানসিকতাটা না থাকলে নতুন ওয়ার্কিং ফিল্ড আপনার জন্য ভালো হবে না। উপদেশগুলো ডাক্তারিতে তো বটেই, সব পেশাতেই উপযোগী। বিঃদ্রঃ উপদেশ দেওয়া ভালো অভ্যাস নয়। তাই উপদেশ কম দিই। নেহাত বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে বলে বছরে একবার করে উপদেশমূলক পোস্ট দিই। নিজগুণে ক্ষমা করবেন। লেখক: চিকিৎসক

বইয়ের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে একটা জাতি জাগে ও বাঁচে 

রউফুল আলম : প্রকাশনা জগৎ থেকে আমেরিকার রেভিনিউ বছরে ২৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ওরা বই প্রকাশ করে যতো টাকা আয় করে, সেই টাকায় প্রতিবছর কয়েকটা পদ্মা সেতু করা সম্ভব। বই পাবলিশ করে জার্মানির ব্যবসা হয় ৬ বিলিয়ন ডলারÑপ্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। সাউথ কোরিয়া, যাদের জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ কোটি, তারা শুধু বই প্রকাশ করে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যাবসা করে। এই তথ্যগুলো ২০১৮ সালের। বাংলাদেশে প্রকাশনা জগতের আকার খুবই ছোট। ২০১৮ সালের বই মেলায় মাত্র ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। সবচেয়ে বেশি বই কিন্তু বিক্রি হয় এই সময়টাতেই। তাহলে প্রকাশনা জগতের বাজারটা কতো বড়ো হবে? ১৮ কোটি মানুষের দেশের প্রকাশনা বাজার হয়তো ৩০০ কোটি টাকা। নাইলে পাঁচশো কোটি। অথচ পাঁচ কোটি মানুষের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় সেই বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার। 

একটা দেশ যতো ধনী হয়, তার বই প্রকাশের সংখ্যা ততো বাড়ে। বইয়ের সংখ্যা ততো বাড়ে। মানুষ ততো বই পড়ে। বিষয়টা শুধু এই নয় যে, মানুষের বই কেনার সামর্থ্য বাড়ে। বিষয়টা হলো মানুষের জ্ঞান আহরণে তৃষ্ণা বাড়ে। শিক্ষিত মানুষ বাড়ে। মানুষ বহু বিষয় নিয়ে পড়তে চায়। বহু বিষয় জানতে চায়। মানুষের গড় আয়ু বাড়ে। মানুষ বই পড়ে সময় কাটায়। আনন্দ নেয়। একটা দেশ যতো ধনী হয়, সে দেশের শিক্ষার মান ততো বাড়ে। ফলে লেখকের সংখ্যাও বাড়ে। পাঠকের সংখ্যাও বাড়ে। আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় তিন-চার লক্ষ নতুন বই প্রকাশ হয়। ইংল্যান্ডেও লক্ষাধিক নতুন বই আসে প্রতিবছর। বাংলাদেশে কয়টা নতুন বই আসে? পাঁচ হাজার? দশ হাজার? ২০২১ সালে বই মেলায় চার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। বই মেলার সময়ই সবচেয়ে বেশি নতুন বই আসে। আমাদের লেখক কম। নতুন বইয়ের সংখ্যা কম। অর্থাৎ বইয়ের জগতে বৈচিত্র্যতাও কম। এটা দুর্ভাগ্য। 

নতুন লেখক তৈরি হওয়া দরকার। নতুন নতুন বই প্রকাশ হওয়া দরকার। তরুণরা লিখুক। বই প্রকাশ করুক। নতুন লেখকদের নিয়ে ট্রল না করে, তাদের জাগিয়ে রাখতে হবে। নতুন লেখকদের নিয়ে তাচ্ছিল্য না করে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। পাঠকই ঠিক করে দিবে লেখকের ভবিষ্যৎ। পাঠকই নির্ধারণ করুক লেখকের টিকে থাকা। প্রতি বছর ধর্মের বই বেশি বিক্রি হয় বলে একটা হৈচৈ উঠে। সমালোচনা উঠে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায় দশ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন। তাদের কাছ থেকে প্রতি বই মেলায় পাঁচশ বইও আসে না! দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণি থেকে যদি বই প্রকাশ না হয়, তাহলে সেই জায়গাটা কি শূন্য থাকবে? 

তরুণরা, লিখো যাও। অসংখ্য বিষয় নিয়ে লিখো। কবিতা, গল্প, উপন্যাস। অণুকাব্য, অণুপ্রবন্ধ, অণুগল্প। শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, ইতিহাস, সাইন্সফিকশন, দর্শন। বিজ্ঞান, যৌনতা, প্রযুক্তি, মনোবিজ্ঞান। রম্য, রান্না, চিকিৎসা, প্রাণীজগৎ। উদ্ভিদ জগৎ, পরিবেশ, সমুদ্র। সব বিষয় নিয়ে লিখো। কাঁচা হাতে লিখো। লিখতে লিখতে পাকা হও। পড়ো, পড়ো এবং পড়োÑতারপর কলম হাতে নিয়ে লিখতে থাকো। একটা দেশ বাঁচাতে হলে বই চাই। ভাষা বাঁচাতে বই চাই। একটা জাতিকে জাগাতে বই চাই। ইতিহাস টিকিয়ে রাখতে বই চাই। বইয়ের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে, একটা জাতি জাগে ও বাঁচে। লেখক: গবেষক। ফেসবুক থেকে