প্রকাশিত: Sun, Jan 29, 2023 4:11 PM
আপডেট: Sat, May 10, 2025 2:48 AM

মনের মতো জটিল যন্ত্র আর একটাও নেই

আহসান হাবিব : মনের মতো জটিল যন্ত্র আর একটাও নেই। মন যে কীভাবে কাজ করে, তা নিখুঁত করে বলাও সহজ কথা নয়। আমরা যে প্রতিমুহূর্তে পরিবেশ থেকে আগত উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দিই, এই সাড়া দেওয়াটাই কি মন? মনে হয় না, আমরা সাড়া দিই বটে, কিন্তু এই সাড়ায় শুধু আমাদের মন তৈরি করে না। এর সঙ্গে আরো অনেককিছু জড়িত থাকে। কী থাকে? আমার মনে হয় আমরা জন্মলাভ করি একটা ডিফল্ট মন নিয়ে। এটা আমাদের অর্জিত নয়, সহজাত। এই সহজাত প্রবৃত্তি প্রতিটি মানুষের আলাদা। এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে চারপাশের বিভিন্ন উদ্দীপনা। এই দুইয়ের মিথষ্ক্রিয়ায় মন গড়ে উঠতে থাকে।

ধরুন, পরিবেশ থেকে একটা সাড়া। কেউ একজন আপনাকে ‘হারামি’ বলে গালি দিলো, কী করবেন আপনি? কী করবেন এটা নানা কিছুর উপর নির্ভর করবে। এটা একটা গালি আপনি জানেন এবং খুবই অপমানজনক একটা গালি, কিন্তু শোনার পর আপনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কারণ কী? কারণ হয়তো আপনি যার কাছ থেকে গালিটি শুনছেন, তার প্রতি আপনার সেরকম কোনো সম্মান বোধ নেই, তার মতামতকে মূল্য দেন না, আপনি ইগ্নোর করলেন। আবার এমনও হতে পারে আপনি রেগে গেলেন, তেড়ে গেলেন এমনকি দু’ঘা বসিয়ে দিলেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে উদ্দীপক একটাই কিন্তু সাড়া দেওয়ার বৈশিষ্ট্য হরেক রকম। এটি প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে। তাহলে মন হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোনো বিষয় নয়। এর প্রচুর অতীত ইতিহাস আছে। মন তৈরিতে উদ্দীপকের একটা ভূমিকা আছে, কিন্তু সেটাই সব নয়।

আবার শরীর এক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেহাভ্যন্তরে যে বিবিধ অঙ্গ আছে, তাদের কাজের প্রতি আমাদের কোনো হাত নাই। কিছু ঐচ্ছিক বিষয় আছে যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি । লিভার কিংবা কিডনির কাজকে আপনি ইচ্ছা করলেও বদলাতে পারবেন না। আমাদের মন তৈরির যে নাটের গুরু মস্তিষ্ক তার কাজের উপর আমাদের কোনো হাত নাই। আপনি স্পর্শ করলে স্নায়ু সেই সাড়া মস্তিষ্কে বহন করে নিয়ে যাবে এবং আপনার কানে কানে বলবে, এটা স্পর্শ। তবে এই স্পর্শের বিনিময়ে আপনার কি মন তৈরি হবে সেটা নির্ভর করছে কে কেমন করে স্পর্শ করছে। স্পর্শের রূপ যেমন মস্তিষ্ক আপনার সেরকম মন তৈরি করে দেবে। তবে মস্তিষ্কের এই তৈরি করার ক্রিয়া আপনি বদলাতে পারবেন না। এই মস্তিষ্কই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সবকিছু। হরমোন বলে যে একটা বস্তু আমাদের শরীরে আছে, সে মস্তিষ্কের নির্দেশে কাজ করে চলে, এখানে আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না। কোনটা আপনার হাতে? উদ্দীপকটা আপনার হাতে। এটাকে আপনি ইচ্ছামতো বদলাতে পারবেন। মনে রাখবেন, উদ্দীপক মন নয়, মন তৈরির উপাদান।

ক্রমে আমাদের বস্তুজগৎ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, তার ভিত্তিতে যে মন গড়ে ওঠে, সেটাই আপনার প্রকৃত মন। এখানে আপনার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রকৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে অর্জিত ইতিহাস জড়িত থাকে। তাই একই প্রশ্নে আপনি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন উত্তর দেন। এই ভিন্নতাই আপনাকে নির্মাণ করে, আপনি সমাজে সেভাবে চিহ্নিত হন। অনেকে বলে থাকেন কেন মন খারাপ তা তিনি জানেন না। কেন এটা হয়?

আসলে তিনি মন খারাপের কারণটিকে তলিয়ে দেখেননি।নিশ্চয় সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। তবে এমন কিছু আছে যা তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না বা চাচ্ছেন না। এই না পারা বা চাওয়ার পেছনেই রয়েছে মন খারাপাের আসল কারণটি। আমরা যে প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য উদ্দীপকের মুখোমুখি হচ্ছি, আমরা কি তার প্রতিটিতে সাড়া দিই কিংবা দিতে পারি? পারি না। কারণ আমাদের মন সাড়া না দেয়ার বিষয়ে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

আমাদের যে মস্তিস্ক, সেটা সবচাইতে জটিল সাইবারনেটিক্স। শুধু তাই নয়, এটা সবচেয়ে জটিল মেকানিক্যাল, ম্যাগনো-ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্র। এর অনুকরণেই তৈরি হয়েছে কম্পিউটার। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত কিন্তু মস্তিষ্ক আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একটি সপ্রাণ, অন্যটি অপ্রাণ। আমরা মস্তিষ্ককে কমান্ড করতে পারি না, কম্পিউটারকে পারি, পারি বলেই এর ক্ষমতা সীমিত কিন্তু মস্তিষ্কের ক্ষমতা প্রায় অসীম। পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত যে কোন উদীপকের বিপরীতে সাড়া দিতে সক্ষম এবং সবথেকে দ্রুত। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি এই মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত এক একটা নিখুঁত যন্ত্র। গন্ধের সামান্যতম ভিন্নতা, মস্তিষ্ক আপনাকে ঠিক জানিয়ে দেবে।

মন তৈরি করার প্রধান উদ্দীপক সম্পর্ক। প্রতিটি সম্পর্ক এক একটা মন তৈরি করে। পিতার একটি মন, প্রেমিকের আর একটি। এইভাবে সহস্র সম্পর্ক সহস্র মন। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় চেতন এবং অবচেতন মন। যা প্রকাশ করতে পারি তাই আমাদের চেতনার অংশ, যা পারি না তা জমা হয় অবচেতন অংশে। এই দুইয়ের আবার সবসময় ট্যাগ ওফ ওয়ার চলতে থাকে। অবচেতনের কোন অংশটা বেরিয়ে পড়বে, তা বলা কঠিন, তবে তা বেরিয়ে পড়বে যে কোন ছুতায়। স্বপ্ন  একটি শ্রেষ্ঠ ছুতা। আবার মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়াটাও একটা ছুতা। আমরা জন্মেই যে সব ডিফল্ট মন পাই, লিবিডো তার মধ্য সবচেয়ে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই লিবিডোই আমাদের মন তৈরির অন্যতম প্রধান ট্রিগার। লিবিডোকে উদযাপন করতে পারে তাদের মন একরকম, যারা পারে না, তাদের আর এক রকম। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ লিবিডো অবদমিত- কিছু কম বেশি। তাই দেখা যায় মানুষ যৌনতা নিয়ে বেশি কথা বলে। খুব বেশি সময় চুপ করে থাকা কঠিন। কারণ অবদমিত লিবিডো বিভিন্ন ফর্মে বের না হলে মানুষ পাগল হয়ে উঠবে। পাগল কিন্তু যৌন অবদমনের একটি ফলও। তাই বলছি মন এক বিচিত্র বস্তু, জটিল এবং সুন্দর। লেখক: ঔপন্যাসিক