প্রকাশিত: Mon, Jan 30, 2023 1:27 PM
আপডেট: Sat, May 10, 2025 2:47 AM

‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ এবং জবরদস্তির আলাপ

কাকন রেজা : এবারের কলকাতা বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বই ‘অসভ্যতা’ পাওয়া যাবে, খোদ তসলিমাই এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন সামাজিকমাধ্যমে। ঢাকার বইমেলাতেও সম্ভবত পাওয়া যাবে। তসলিমার বই, বইমেলাতে থাকবে না, এমনটা হওয়ার কথা নয়। জানি, একশ্রেণির মানুষের তসলিমার লেখা নিয়ে অ্যালার্জি রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই না পড়ে চুলকানোতে আক্রান্ত হন। কারণ পড়লে তার যৌক্তিক জবাব খুঁজতেন, চুলকাতেন না। তসলিমার যেসব যুক্তি, তা খণ্ডন করা খুব কঠিন কাজ নয়। তার কথা দিয়েই তার জবাব দেয়া যায়। তার লেখা ও কাজেকর্মের সবখানেই কন্ট্রাস্ট রয়েছে। রয়েছে নিজের সাথে নিজের দ্বৈরথ। সেই দ্বৈরথকে সামনে এনেই জবাব দেয়া সম্ভব। কিন্তু সেই জবাব না দিয়ে তার বই নিষিদ্ধ করা কিংবা তসলিমাকে নিষিদ্ধ করার যে অহেতুক কাণ্ড, তাতেই তসলিমা আজ হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছেন। এটুকু না হলে, তার চিন্তা বা লেখার যে ধারা তা এতদিনে বালিতে হারাতো। তসলিমা যেমন মুখে ধর্ম বিদ্বেষের কথা বলেও শিবলিঙ্গে ‘জল’ ঢেলেছেন তেমনি আমাদের দেশের কিছু মানুষ বিরোধিতার নামে তসলিমার তরক্কির গোড়ায় ‘পানি’ ঢেলেছেন। 

নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটিই খারাপ। বরং কোন চিন্তাকে তার বিপরীত চিন্তা দিয়ে জবাব দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত। এবারের বইমেলায় ফাহাম আব্দুস সালামের বই ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ নিয়ে যা হলা তা সেই নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ারই অংশ। ফাহাম যা লিখেছেন তার বিপরীত যুক্তি দিয়ে, চিন্তা দিয়ে তাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করা যেত। ফাহাম যে চিন্তা ধারণ করেন তা এদেশের অনেক মানুষেরই চিন্তা। সেই চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করার সুযোগ তো ফাহামের বই। ফাহামের বইকে যদি চ্যালেঞ্জ করা যায়, তার যুক্তিকে খণ্ডন করা যায়, ভুল প্রমাণ করা যায়, তাহলে তো ডাবল লাভ। তাকেও থামানো গেলো, যারা তার মতন চিন্তাকে ধারণ করেন তাদেরও ভুল প্রমাণ করা হলো। নিষিদ্ধ করা মানে দাঁড়ায়, কোনো চিন্তার বিরোধিতার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে দেয়া। মানুষকে ভাবতে বাধ্য করা, সেই চিন্তার সফলতার দিকটি। 

ভাববাদের বিপরীত চিন্তা বস্তুবাদ। ঈশ্বরবাদের বিপরীতে নিরীশ্বরবাদ। দর্শন এই বিপরীতমুখী চিন্তার কোনোটাকেই পরিত্যাজ্য বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। কারণ দর্শন বিশ্বাস করে চিন্তার দ্বন্দ্বে। দ্বন্দ্ব থেকেই সত্য বেড়িয়ে আসে। ঈশ্বর নেই এমন চিন্তার বিরুদ্ধে যে চিন্তা ঈশ্বর আছে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়, তাতে ঈশ্বরই মহিমান্বিত হন। যুক্তি প্রমাণ করে ঈশ্বর আছেন। সুতরাং ঈশ্বর নেই এমন চিন্তাকে নিষিদ্ধ করা মানে, ঈশ্বরের অবস্থানকে উল্টো দুর্বল করা। চিন্তা ও সমর্থনে দুর্বলরাই জোর করে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে চায়। দেশে দেশে ফ্যাসিজম ও ফ্যাসিস্টদের কর্মকাণ্ড অন্তত তাই প্রমাণ করে। যাদের নিজের পক্ষে শক্ত যুক্তি নেই, সমর্থন নেই, তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে জোর জবরদস্তির আশ্রয় নেয়। সুতরাং নিষিদ্ধ করার চিন্তা ফ্যাসিস্ট চিন্তা। আর যাই হোক জোরজবরদস্তিতে কোন কিছু প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ক্ষমতা বা চিন্তা কোনটাই নয়। লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক