প্রকাশিত: Mon, Feb 13, 2023 4:17 PM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 1:58 PM

ফাগুনের ভালোবাসা

গোলাম সারোয়ার : বহু বিষাদের পর জগতে বসন্ত আসে। বসন্ত আসে প্রেম, আনন্দ, আধ্যাত্মিকতা আর তারুণ্য সাথে নিয়ে। টি এস এলিয়ট বলেন, ‘আমার সমাহিত জীবন এবং বসন্তের প্যারিস, আমি অপরিমেয় শান্তি অনুভব করি এবং জগতকে সুন্দর এবং তারুণ্যময় হিসেবে পাই’।


হ্যাঁ, ধরিত্রী তারুণ্যময় হয়ে উঠে বসন্তে। জগতে ভালোলাগার আগমন ঘটে। হাঁটতে ভালো লাগে, বেড়াতে ভালো লাগে, বাতাস ভালো লাগে, জল নদী মাটির গন্ধ ভালো লাগে। বসন্ত আসতে থাকে আর শরীরে যৌবনের জাগরণ আসে। অনুভবে আসে সেই প্রথম শৈশব থেকে যৌবনে প্রবেশের বিস্ময়কর দিনগুলোর কথা। ফাগুন আসে বসন্তের আগমনি সংবাদ নিয়ে। শরীর টের পায়, আত্মা টের পায়, প্রকৃতি টের পায়, টের পায় জীবনানন্দের ‘এ নদীর জল/তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল’।


বসন্ত মানুষকে কবি করে তোলে। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই কবি, প্রতিটি মানুষই দার্শনিক। কেউ তা সাংগঠনিকভাবে প্রকাশ করে যায়, কেউ তা করে না। তবুও সব মানুষ ক্ষণে ক্ষণে বলে যায়, যেগুলো হারিয়ে যায় মহাজগতের মাঝে। মহাবিশ্ব সেগুলো ধারণ করে ইথারে ইথারে। ইথারে ভেসে বেড়ানো শব্দ যেদিন মানুষ উদ্ধার করতে পারবে, সেদিন মানুষ জানতে পারবে জগতে মানুষ যা প্রকাশ করে গিয়েছিলো পাথর থেকে চামড়ায়, ভুজপত্র থেকে কাগজেÑ তার চেয়েও মানুষ বেশি রেখে গেছে ইথারে ইথারে। 


আমাদের কালে ইথারের ভাষা হয়তো উদ্ধার হবে না। আমাদের তাই নিজেদের ভাবনার কথা মিলাতে হলে যেতে হয় প্রকাশিত কবিদের কাছে। ভালোবাসা আর বসন্তের কথা নিগূঢ় মানবাত্মার কথা। প্রণয়ের কবি জন কিটস বলেন, ‘এমনকি মৌমাছিও জানে বিষ ফুলের মাঝেও সবচেয়ে সমৃদ্ধ রস থাকে বসন্তে’। হ্যাঁ, এই হলো বসন্তের পরমতত্ত্ব।


বসন্ত হলো ভালোবাসা আর সৃষ্টিতত্ত্বের মূল কালপর্ব। আমাদের প্রেমের কবি জীবনানন্দ বলেন, ‘মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে/ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি, তাহাদের সাথে/সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন/মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো। তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা-সিন্ধুর রাত্রির জলযানে/অর্ধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে; কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে’!


হ্যাঁ, বসন্ত মানুষকে অনন্যোপায় করে, উদ্বেল করে, ভালোবাসার কাছে প্রবল আকর্ষণে টেনে নিয়ে যায়। এভাবেই মানুষের জন্ম হয় পৃথিবীতে। প্রবল শৈত্যপ্রবাহ আর সলিলের আদি পৃথিবীতে যখন আরক্ত সূর্য নিয়ে প্রথম বসন্তের প্রভাত নেমে এসেছিলো তখন মানুষ কি আনন্দে উথলিয়ে উঠেনি। কবি অক্ষয় কুমার বড়াল বলেন, ‘দিল করে পুষ্পগুচ্ছ, শিরে পুষ্পলতা, অতিথি সৎকার/নিশীথে বিচিত্র সুরে, বিচিত্র ভাষায়, স্বপনসম্ভার’। জি, সেই আদি অসহায় নরনারীও ভালোবাসা অনুভব করেছিলো বলেই ভালোবাসার মানুষের জন্যে বন্য বিচিত্র ফুল লতা মাথায় পরে সেজেছিলো, বিচিত্র ভাষায় স্বপনের গান করেছিলো, হৃদয়কে করেছিলো প্রণয়ের অনুকূল। করেছিলো বলেই জগতে মানুষের বিস্তার ঘটেছে। 


সিন্ধু সভ্যতায় বসন্ত প্রবেশ করে ফাগুনের প্রথম প্রহর ধরে। জগতের মানুষ এখন অশান্ত হয়ে উঠেছে। মানুষের ভিতরে অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে। এই অসহিষ্ণুতা প্রশমিত করতে হলে জগতে প্রণয়ের আবাদ করতে হবে। ভালোবাসাকে জগতের সবচেয়ে উপরে স্থান দিতে হবে। প্রণতি জানাতে হবে তাই ফাগুনের প্রথম প্রহরকে। বলতে হবে গুরুর কথা, ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান’। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট