
প্রকাশিত: Sun, Feb 26, 2023 5:29 PM আপডেট: Thu, Jun 26, 2025 8:37 PM
অভিজিৎ রায় নামক কষ্টিপাথর এবং আমাদের সমাজ
রাজিক হাসান : সেদিন আমি লন্ডনে, সন্ধ্যার পর বাড়িতে বসে টিভি দেখছিলাম। এক বন্ধুর ফোনে জানতে পারি নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎকে। বিশ্বাস করতে পারিনি প্রথমে, দ্রুত লগইন করি ফেসবুক। দেখলাম অভিজিৎকে বইমেলায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিজিতের সহধর্মিনী জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হলাম দেখে আমারই বন্ধু যাদের সঙ্গে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি, সময় কাটিয়েছি তাদের অনেকেই এই হত্যাকে নীরব সমর্থন দিয়েছে। যখন নিশ্চিত হলাম অভিজিৎ আর নেই কান্নায় ভেঙে পড়ি আমি। অঝোরে কাঁদি কিছু সময়। তারপর শুধু একটি লাইন লিখে আমি পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকেÑ ‘অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে নাস্তিক হওয়ার দরকার নাই, মানুষ হওয়াই যথেষ্ট’। ফেসবুক থেকে শিখছি, জানছি, দেখছি অল্প পরিমাণে হলেও কিছু সত্য, বেশি শুনছি যদিও অসত্য আর মতলবি প্রচারণা আর কুতর্কের ডামাডোল। এর সবকিছু থেকে নিট লাভ হলো, মানুষ চেনা।
মুখোশের পেছনে কার চেহারা কী রকম তা জানছি। অনেককালের চেনা সুন্দর চেহারাগুলো মুখোশের পেছনে কীরকম কদর্য, ভয়ংকর আর বীভৎস হতে পারে তা দেখে চমকে উঠছি অহরহই। আর এটা দেখতে পাই তাদের নানান স্ট্যাটাস, কমেন্ট আর ‘লাইকে’র মাধ্যমে। আমার স্ট্যাটাস, যেটা খুব সাদামাটা প্রতিবাদী স্ট্যাটাস মনে হয়েছিল আমার কাছে, সেটা যে পার্থের তীরের মতো এতটা লক্ষ্যভেদী হবে তা বুঝতে পারিনি প্রথমে। একে একে মন্তব্যগুলো পড়ে আমার নতুন বোধিসত্ত্ব লাভ হলো, খুলে গেলো আমার বন্ধু তালিকায় থাকা অনেকের মুখোশের পেছনের চেহারা। আতঙ্কিত হলাম। নানান জন নানান কুযুক্তির আড়ালে সমর্থন করছে অভিজিতের ওই হত্যাকাণ্ডটিকে। একজন কথা পেঁচালেন এই বলে যে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো অভিজিত হত্যারও কিছু হবে না।
যখন আরেকজন ওই জনাবের ভুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন যে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারের রায় বেরিয়েছে, জনাব তখন উত্তর দিলেন ওই হত্যাকারীদের ফাঁসি হয়নি কেন এখনো। এবার বোঝেন ঠেলা কীভাবে দুটো হত্যাকাণ্ড এক-কাতারে ফেলে দিয়ে দুটোকেই লঘু করে দেওয়া হলো। আরেকজন আবার হাজির করলেন পরিসংখ্যান, বললেন কারা পৃথিবীর ৯০ ভাগ নৃশংসতার জন্য দায়ী, আর কাদের বিরুদ্ধে হয় ৯৫ ভাগ প্রচারণা। বোঝেন এবার অভিজিত হত্যার ব্যাপারে এই পরিসংখ্যানবাবার সমর্থন কোন দিকে। পরিসংখ্যানবাবাকে যদি বিখ্যাত প্রচলিত কথাটি বলি যে মিথ্যা তিন রকমের, তা হলো ‘মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান’ তবে নিশ্চিত অন্য ছুতায়, তিনি সমর্থন যোগাবেন হত্যাকারীদের। আরেকজন আবার ঘটাং করে রায় দিলেন, অভিজিৎ হিন্দু, আর বাংলাদেশে হিন্দুদের নিয়তি এরকমই হবে। উনি চলে গেলেন সাম্প্রদায়িকতায়।
এক ধার্মিক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি নিজে নাস্তিক কিনা। এই জিজ্ঞাসায় আমি দেখতে পেলাম আমার প্রতি তাক করা আরেক শানানো মধ্যযুগীয় চাপাতি, তলোয়ার। সে যাক, মন্তব্যের সংখ্যা বিচারে মনে হলো খৃ: পু: ৩৯৯ সালে ৫০০ জনের মধ্যে ২২০ জন এথেনিয়ান জুরি সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছিল, শতকরা হিসাবে ওই সংখ্যার কাছাকাছি দূরে থাক, খুবই নগন্য পার্সেন্টকে দেখলাম অভিজিৎ ঘটনাটির নিন্দা বা প্রতিবাদ জানাতে। তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠই ইনিয়ে, বিনিয়ে, তেনা পেঁচিয়ে হত্যাকাণ্ডটিকে সমর্থন করে গেলো। মনে রাখা দরকার, এখানে কিন্তু বিশাল একটা গুণগত পার্থক্য আছে, এথেনিয়ানরা উন্মুক্ত বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ জুরির রায়ে, সক্রেটিসকে হেমলক পানে আত্মহত্যা করিয়েছিল, কোন কাপুরুষ বর্বর দুপেয়ে অতর্কিতে তাকে খুন করেনি।
তারপরও আজও মানবতা সেই ঘটনা নিয়ে অনুতপ্ত হয় প্রতিনিয়ত। আর হায় আমরা কিনা করছি সরবে নীরবে ইনিয়ে, বিনিয়ে ত্যানা পেঁচিয়ে হন্তারকের সমর্থন, সক্রেটিস কাণ্ড ঘটে যাবার তিন হাজার বছর পর। জানি কেউ আবার কুতর্ক জুড়ে দিতে পারেন আমার সঙ্গে, এই বলে যে, অভিজিৎকে কেন আমি সক্রেটিসের কাতারে তুলে দিলাম এখানে। সেই তার্কিকদের উদ্দেশে বলছি, অভিজিৎ কোন কাতারের মানুষ তা ঠিক করবে আগামর মহাকাল, আমি এখানে শুধু তুলনা করছি ঘটনার পরম্পরার আর ওই সময়ের মানুষের সঙ্গে আমাদের মানসিকতার। আসলে মুক্তচিন্তা, বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা যা নাকি মানব সভ্যতাকে আজকের স্তরে এনেছে তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তার উদারতার ফাঁকতালে মানব সমাজে মুখোশ এঁটে সতত ঘুরে বেড়ায় বর্বর দুপেয়েরা আর সুযোগ পেলেই চালায় তাদের সদা উদ্ধত হিংস্র ছুরি, চাপাতি, তরবারি। তারপর ঢেঁড়া পিটিয়ে গায় গান, কীভাবে কারো বা কোনো গোষ্ঠির বিশেষ অনুভূতি মর্মান্তিকভাবে আহত হয়েছিল, যার কারণে ওই বীভৎস ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক। আর নিরপেক্ষ নামের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভন্ডরা দিয়ে যায় ওই সব বীভৎসতাকে নিরব সমর্থন।
ফাস্ট লাইফ, ডাইনামিক ক্যারিয়ার, শাইনিং ফিউচার, বাদ দিয়ে অভিজিৎ দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেনÑ পৃথিবীর চিন্তায় অনুন্নত একটি অঞ্চলের মানুষকে আধুনিক করার, আলো হাতে আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখানোর, শতব্যস্ততার মাঝে তৈরি করেছেন মুক্তমনার মতো সুবিশাল জ্ঞানের ভান্ডার, তন্নতন্ন করে খুঁজে খুঁজে সমৃদ্ধ করেছেন ‘মুক্তচিন্তা’ নামক আধুনিক ভাণ্ডার, একটি অনিচ্ছুক, অন্ধকারপ্রিয় জাতির জন্য আনতে চেয়েছেন ঝলমলে চিন্তার রৌদ্র। অভিজিৎ জানতো আক্রমণ আসবে। সে মারসেনারী নয়, সে মাঠের ফ্রন্টাল যোদ্ধা। তাঁকে কী করতে হবে সে খুব ভালো করে জানতো। তার জানা বাকি ছিল না যে প্রযুক্তিগত উন্নতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের চর্চা এবং শিল্প-সাহিত্য-মূল্যবোধ, মানুষের ভাবরাজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে অধ্যাত্মবাদের চর্চা দেশে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার ইঙ্গিতই বহন করছে, কেননা ইদানীংকালে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান আর আধ্যাত্মবাদের এক অদ্ভূত সংমিশ্রণ।
তাঁর মৃত্যু আমার কাছে এক বজ্র-নির্ঘোষী প্রতিবাদ-প্রতিবাদ ধর্মোন্মাদদের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ তাবৎ শোষকদের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ভাবরাজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তিবিজ্ঞানবিরোধী অতিপ্রাকৃতবাদ, ঈশ্বরবাদ, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রভৃতি নানা ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের পথ ধরে। তাই অভিজিৎ জেনেশুনে সাহসিকতার সঙ্গে মধ্যমাঠ থেকে প্রতি-আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। হি ইজ আ ফলেন কমরেড। অভিজিৎ শহীদ হয়েছে। শহীদের মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য। তাঁকে ঊনমান্যতা দেবার সাধ্য কারো নেই। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড কিছু নির্মোহ সত্যের মুখোমুখি করেছিল আমাদের। যা ছিল আড়ালে, ছিল ভান হয়ে, মুখোশ নৃত্যের সঙ্গে ভেল্কি দেখাতো যা, তার অবসান হয়েছে অভিজিতের মৃত্যুতে। সেই দুঃসময়ে খুলে পড়েছিল মুখোশ, সরে গিয়েছিল পর্দা, মঞ্চের সকল কুশিলব, এ নির্মম মৃত্যুতেও নির্বিবেক থাকতে পেরেছিল যে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ অপরাপর পেশার কিছু মুখ, চিনে নিয়েছি ওদের। অভিজিৎ চলে গেছেন, মোহমুক্ত হয়েছি আমরা। অভিজিৎ নামক কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিয়েছি ওদের। ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
