শামসুদ্দিন পেয়ারা : ধরা যাক, ভারতের অনাগ্রহ ও আপত্তি অগ্রাহ্য করে মার্কিন উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং জনগণের ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ২০২৪ সালের কোনো এক সময়ে বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো এবং সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলো এবং বিএনপি জয়ী হলো। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির নতুন সরকার গঠিত হলো। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেন। উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হলো তাঁর পুত্র বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানকে। মানুষের মনে এক উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন নতুন করে বাসা বাঁধতে শুরু করলো। 

 তারপর? তারপর কী হবে? গণতন্ত্র এসে যাবে? ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যাংক-লুট ক্যাডার বাহিনীর দুর্বৃত্তপনা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি পিস্তলবাজি সব ভোজবাজির মতো বাতাসে মিলিয়ে যাবে? জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক পার্টির গুন্ডারা টেণ্ডার বাক্স ছিনতাই করবে না? দরপত্রের টেন্ডারদাতারা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াবে না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ক্যাডার সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়ে যাবে? ছাত্রদলের হাতি নেতা, পাতি নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে তাদের সিট ব্যবসা দ্বিগুণ উৎসাহে চালু করবে না? পুলিশি নির্যাতন শেষ হয়ে যাবে? চাল, ডাল, তেল, নুনের দাম ৪৫ ডিগ্রি হারে উর্ধ্বমুখী হতে থাকবে না? ব্যাংক লুটেরারা সবাই মুখ মুছে সাধুসন্ত হয়ে যাবে? বিদেশের বেগম পাড়াগুলোয় সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা নতুন নতুন ম্যানশনের মালিক হতে থাকবে না? ছা-ছমুছার ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ হবে না? থিসিস চুরির পিএইচডি ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানে শাটার টেনে দেবে?

ক্ষমতার গদিতে ইনার বদলে উনি বসলেই বুঝি ভাত কাপড় শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আকাশ-কুসুম কল্পনারএকটা সীমা থাকা দরকার, বোকার স্বর্গে আমরা আর কতকাল বসবাস করবো? বিএনপি কি আওয়ামী লীগের থেকে ভিন্ন প্রজাতির কোনো রাজনৈতিক দল? আমরা কি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ক্যান্টনমেন্টগুলোতে নানা মনগড়া অভিযোগে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও অফিসারকে বিনাবিচারে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে দেখিনি? খালেদা জিয়ার শাসনামলের দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন অত্যাচার নির্যাতন ও হাসিনার আমলের মতোই রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ী নেক্সাস কি করে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে জনগণের পেটে লাথি মেরে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে, সে সব দেখিনি? হাওয়া ভবনের কথা আমরা কি এত তাড়াতাড়িই ভুলে গেছি? বেগম জিয়ার ছেলে তারেক রহমান ও তার পেটোয়া বাহিনী কি করে রাষ্ট্রের সম্পদ দু’হাতে লুণ্ঠন করেছিল সেটা আমাদের স্মৃতিতে এখনো দুপুর-সূর্যের মতোই উজ্জ্বল হয়ে আছে। 

হাওয়া ভবন কি করে রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতো তা সবার মনে আছে। কাজেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণে জালিয়াতিমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ফলে যে দলটি ক্ষমতায় আসবে সেটার স্বভাব চরিত্র ও রাজনৈতিক ট্র্যাক রেকর্ড পনের বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্বভাব চরিত্র ও ট্র্যাক রেকর্ডের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। উভয়েই অদক্ষ, অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত, রাষ্ট্রসম্পদ লুণ্ঠনকারি, দেশপ্রেম বর্জিত ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর লুটের টাকার পার্সেন্টেজভোগী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্ত। যদি পরিবর্তন হতেই হয়, তা হলে এই দুই দল-জোটের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দেশ শাসনের কোনো সুযোগ না রেখে, সম্ভব হলে এদের উভয়কে বাদ দিয়েই, সে পরিবর্তন আনতে হবে। দুই কি তিন টার্ম এই দু’দলকে রাজনীতি ও ক্ষমতা থেকে দূরে রেখে আধুনিক বিশ্বে অচল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ‘এক ভোটের মেজরিটি পদ্ধতি’ পরিহার করে নতুন ‘সংখ্যানুপাতিক ভোটের নির্বাচন পদ্ধতি’ গ্রহণ ও চালু করতে হবে। সেটা করতে পারলেই বাঙলাদেশে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে, তৃণমূলের মানুষের চিন্তা ও আশা আকাঙ্ক্ষা সরকারি আচরণে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত ও বাস্তবায়ীত হবে। জয় বাংলা। মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক