প্রকাশিত: Thu, Mar 2, 2023 3:21 PM
আপডেট: Thu, Jun 26, 2025 1:25 PM

রবীন্দ্রনাথের গুম হওয়া এবং প্রাসঙ্গিকতা

কাকন রেজা : আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ মজলুমের প্রতীক নন। রবীন্দ্রনাথ আর্ট-কালচার করা তথাকথিত অভিজাতদের স্বস্তিকার চিহ্ন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাদের দেশের গরিব মেহনতি মানুষদের কোনো সংযোগ নেই। বিশ্বাস হয় না? চিন্তা করে দেখুন তো, রিকশায় উঠেছেন কোনো রিকশাওয়ালাকে গুনগুন করে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে শুনেছেন কিনা? নিশ্চিত শোনেননি। শুনেছেন উবারে কিংবা ব্যক্তিগত পশ গাড়ির স্টিরিওতে। রিকশা আর উবারের পার্থক্যটা যেমন রবীন্দ্রনাথ এবং আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক তেমনি। যে জনগোষ্ঠী শোষিত এবং শাসিত। প্রয়াত এক অর্থমন্ত্রীর কাছে দামের পাঁচটাকা বৃদ্ধি কোনো ব্যাপার ছিলো না। কিন্তু সেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যাদের পাঁচ টাকা মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠে যায়। মূল কথায় ফিরি। চারুকলার শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথের মুখে টেপ মেরে, বইয়ে পেরেকবিদ্ধ করে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মুখে টেপ আঁটা ভাস্কর্য। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই মূর্তিও গুম হয়েছে রাতের আঁধারে। সেখানে শিক্ষার্থীরা ব্যানার টানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ গুম হয়েছেন বলে। প্রতিবাদ করতে গেলে গুম হতে হয় এটাই বুঝিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। যাক এই অন্তত একটা জায়গায় রবীন্দ্রনাথ সফল হলেন আমাদের সমাজের সঙ্গে একাত্ম হতে। আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথের সাফল্য এই একটাই, যার পেছনে রয়েছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। বাক স্বাধীনতা ও মুক্তমত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা অজান্তেই পুরো বাস্তবতা দৃশ্যায়ন করেছেন। জানি না একে ‘শাপে বর’ না ‘বরে শাপ’ বলবেন। শাপ যেমন বর হয়, তেমনি বরও কখনো শাপ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে সমস্ত ঘটনা তাই হয়েছে কারও কারও জন্যে। 

আমাদের রামবুদ্ধিজীবীগণ রবীন্দ্রনাথকে শিকেয় তুলে রেখেছিলেন। চারুকলার শিক্ষার্থী বুঝে হোক আর না বুঝে হোক রবীন্দ্রনাথকে শিকা থেকে নামিয়েছেন। তাকে প্রতিবাদের উপলক্ষ করে তুলতে চেয়েছেন। এটাও একধরণের শিক্ষা তথাকথিত রামপ্রগতিশীলদের জন্য। যারা প্রগতিশীলতাকে রবীন্দ্রনাথের মতন শিকেয় তুলেছেন। যা বিশেষ শ্রেণি ছাড়া ধরাছোঁয়া যাবে না। বেদ’র মতন, শুধু ব্রাহ্মণরাই পড়তে পারবেন। রবীন্দ্র রচনাবলীও অনেকটা তাই। সেজন্যেই রিকশাওয়ালারা ‘ভদ্দরলোক’ এর গান বলে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে সাহস করেন না। অথচ লালন, শাহ আব্দুল করিম এমনকি নজরুলও তাদের ঠোঁটে গীত হয়। রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ মানুষের যোগ্য করে তোলার চারুকলার চেষ্টা প্রগতির মুখোশে চরম প্রতিক্রিয়াশীল আর্ট-কালচার করা কুলীনদের জন্য ‘বরে শাপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হারাধনের দশ ছেলের মতন ক্রমশ সবই হারাচ্ছেন তারা। এখন সম্ভবত শঙ্কায় রয়েছেন সবেধন নীলমনি রবীন্দ্রনাথও গেলো বলে। 

শেষে একটা প্রশ্ন করি, কোন দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ শোষিত ও শাসিত শ্রেণির প্রতিভূ ছিলেন? কবে ছিলেন? ধানাইপানাই করতে পারেন কিন্তু জবাব দিতে পারবেন না। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের কিছু রচনা সামনে আনতে পারবেন, কিন্তু খোদ রবীন্দ্রনাথকে কখনোই পারবেন না। রবি বাবুর নাইটহুড উপাধি ত্যাগের কথা তুলবেন তো। কিন্তু ভাইরে, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পরও যদি তিনি নাইটহুড রাখতে চাইতেন তাহলে সে সময় তার বুদ্ধিবৃত্তিক অস্তিত্বই বিপন্ন হতো। তবে এটুকু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বর্তমানের পুরস্কার পাগল লেখক-কবিদের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ চক্ষুলজ্জা সম্পন্ন ছিলেন। বৃটিশদের বিরুদ্ধে সে সময়ে মানুষের বিক্ষোভ বিদ্রোহকে রামবুদ্ধিজীবীরা শৃঙ্খলা পরিপন্থী বলে আখ্যা দেন। তাদের ধারণায় জনগণ ছিলো ‘আবেগতাড়িত’। একথা লিখেছেনও অনেকে। 

আজব না। দেশপ্রেমটাই তো আবেগ। আবেগ না থাকলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কীভাবে হবে? কীভাবে মানুষ বিপ্লব করবে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। মানুষের বিদ্রোহকে তারা বিশৃঙ্খলা বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এসব রামবুদ্ধিজীবীরা বিদ্রোহ কীভাবে শঙ্খলাবদ্ধ হয় তার কোনো সূত্র আজ অবধি দিতে পারেননি। মজার ব্যাপার গান্ধীজিকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ খোদ এমন কথাই লিখেছিলেন। রামবুদ্ধিজীবীরা পারার মধ্যে রবি বাবুর সেই চিঠিকে নানা ভাবে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। তাকে নিরর্থক বিপ্লবী প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, যে চেষ্টা আজ অবধি জারি রয়েছে। রবি বাবুর চিঠিটা যারা পড়েছেন, একটু হিসেব করলেই মেলাতে পারবেন সে চিঠির একটি বাক্যেও মূলত বিপ্লবের কথা নেই, রয়েছে চাণক্যের কৌশলী আপোসের আলাপ। শৃঙ্খলার নামে বেহাত বিপ্লবের কথামালা। 

ফুটনোট : বলবেন, রবীন্দ্রনাথকে আপনিও পড়েন এবং শোনেন। হ্যাঁ, পড়ি এবং শুনি বলেই জানি, রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর মানুষের নন। গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতন একটা আঁতেল শ্রেণি তাকে আরও বৃত্তবন্দি করেছেন। মধ্যবিত্ত থেকেও তাকে আলাদা করে উচ্চবিত্তে স্থান দিয়েছেন। বর্তমানের রবীন্দ্রনাথ উচ্চবিত্তের মানে ধনী আঁতেলদের। 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট