প্রকাশিত: Sat, Mar 4, 2023 6:28 AM
আপডেট: Thu, Jun 26, 2025 12:53 PM

কান্না গিলে গিলে, আগুন প্রসব করে করে জীবন কুড়িয়েছি অন্ধ দুয়োরাণীর মতো

সাদিয়া নাসরিন : আব্বা আমাকে বলতেন, ‘গণ-কেস’। কারণ আমি বিসিএস দিইনি, আমলা হইনি। আব্বার স্বপ্নের মতো পাটভাঙা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা কলেজ প্রিন্সিপাল হইনি। আইন পাস করেও আইনজীবী হইনি। অর্থনীতি পড়েও ইকোনোমিস্ট হইনি। আমি আসলে কিছুই হইনি। কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। কোনো কোনো সময় জীবনের মানেই হয়তো কিছুই না। হয়তো শুধু শুধুই ফুল ফোটে, শুধু শুধুই বর্ষা নামে, জোছনার ফিনকি ঝরে তাও অকারণেই। এমন সময় জীবনানন্দের মতো ‘জীবনের এই স্বাদ সুপক্ক ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেল’ সবই অসহ্য বোধহয়, মর্গেই হৃদয় জুড়োতে চায়। আম্মার বিছানায় শুয়ে শুয়ে চরম খিটখিটে মেজাজে মনে হচ্ছিলো, ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়Ñআরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে। ক্লান্ত-ক্লান্ত করে...। তবুও পরমুহূর্তেই এমন কে নো আলো জ্বলে উঠে যে, জীবন ভীষণ সুন্দর আর অর্থবহ হয়ে উঠে। সেইসব ‘সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা’ দেখতে দেখতে বুঝা যায়, জীবনের অনেক রকমের মানে আছে। 

ঢাকা এয়ারপোর্টে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলাম, এমন সময় একজন মাঝবয়সী সৌম্য দর্শন মানুষ এগিয়ে এসে কথা বলতে চাইলেন। আমি সম্মতি দিতেই বললেন, ‘আপনি কি জানেন, আপনার প্রতি আমার পরিবারের অনেকটুকু ঋণ আছে’? আমি কোনো রকমে বিস্ময় সামলে জানতে চাইলাম, কী রকম? তিনি তাঁর স্ত্রীর পরিচয় জানিয়ে বললেন, ‘আমাদের একমাত্র সন্তানটি কিশোর গ্যাংট্যাং এসবে ইনভলব হয়ে গিয়েছিলো, ড্রাগ ট্রাগও নেওয়া শুরু করছিলো। আমার স্ত্রী ব্যাংকার, আমি ব্যবসা করি। আমরা কেউই তেমন করে তার প্যারেন্টিংটা করতে পারিনি। আপনার একটি লেখা পড়ে আমার স্ত্রী খুব নাড়া খেয়েছিলো। এরপর সে ম্যাসেঞ্জারে আপনার সঙ্গে কথাও বলেছিলো। আপনি সেই ব্যাক্তি যে আমার স্ত্রীকে সাহস দিতে পেরেছেন আমাদের একমাত্র সন্তানকে ফিরিয়ে আনার। আপনার পরামর্শে আমরা তাকে কাউন্সেলিং করিয়েছি, তার সঙ্গে ইন্টিমেট হয়েছি। আপনি নিজে থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিয়েছেন, নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন... আল্লাহর রহমতে সে রিকভার করেছে, এডুকেশনে ফিরে গেছে। আমি জানি না আপনাকে কী বলা উচিত, আপনি কি একদিন আমার বাসায় আসবেন? এসব মুহূর্ত আমাকে নৈঃশব্দের কাছে পৌঁছে দেয়। কতো বাতি আমার অজ্ঞাতেই জ্বলে যায়, কোথাও না কোথাও, কারো না কারো কাছে আমার জীবনের এতো উজ্জ্বল মানে আছে। 

কয়েকদিন আগে, অভিজিৎ রয়ের স্মরণ সভায় দাঁড়িয়েছিলাম। পাশ থেকে একজন কান্তদেহী নারী এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি সাদিয়া নাসরিন’? আমি বললাম, জ্বী। তিনি আমার হাতটা ধরলেন। বললেন, ‘আপনার লেখা আমি বুকের ভেতরটা দিয়েই পড়ি। আমি একজন ৬৩ বছরের নারী। তবু আপনার বয়সকে আমি উপলব্ধি করতে পারি আপনার লেখা দিয়েই। আমার তারুণ্যে আপনার মতো সাহস আমার ছিলো না, কিন্তু এখনো ঠিক কাজটি করার অনুপ্রেরণা পাই, শক্তি ফিরে পাই উঠে দাঁড়াতে পারি, আপনার লেখা পড়ে’। কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরছি, খুব ক্লান্ত। এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে এক মেয়ে বারবার কল করছিলো। আমি একটু বিরক্ত হয়েই রিসিভ করলাম। ওপাশের মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদছিলো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি বারবারই বলছিলো, ‘আপু, আজ সকাল থেকে আমি মরে যাওয়ার জন্য একমুঠো ঘুমের ওষুধ নিয়ে ঘুরছি। কিন্তু এখন আমার মনে হলো একবার আপনার সঙ্গে কথা বললে, একবার আপনার হাতটা ধরতে পারলে আমি মনে হয় আরেকবার চেষ্টা করতে পারবো। আপনি কি একটু কথা বলবেন আমার সঙ্গে’? 

সেদিন আমার নিজের মনই এতো খারাপ ছিলো যে, আমি ঘরছাড়া গান শুনতে পাচ্ছিলাম ভেতরে। তবু সেদিন সেই ছিবড়ে হয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় মেয়েটির কথা শুনে আমার মনে হয়েছিলো, এই আমার জীবনের মানে। তবে কি সব শেষ হয়নি, এই জীবনে কতোবার আমি নিজেই পথ হারিয়েছি, হোঁচট খেয়েছি, কাঁটা বিঁধে রক্তাক্ত হয়েছি। সেই দিনগুলোতে আমি নিজেই কতোবার দিশেহারা হয়েছি। কতো বিষাদের ভোরে মৃত্যু এসে কড়া নাড়িয়ে গেছে। আমি কাউকেই পাইনি একটু হেলান দেওয়ার মতো। কান্না গিলে গিলে, আগুন প্রসব করে করে জীবন কুড়িয়েছি অন্ধ দুয়োরাণীর মতো। তাই বুঝি কুড়িয়ে পাওয়া এসব ভালোবাসার কারণেই জীবনটা অসম্ভব রকমের অর্থবহ হয়ে উঠে। তখন মনে হয়, ‘কতো লক্ষ জনম ভ্রমণ করে এমন মানবজীবন মেলে’। হায় লেখা, কতো অচেনা পথকে এনে মিলিয়ে দিলে তুমি আমার পথের সীমানায়। তবে কি লেখাটাই আমার জীবনের একমাত্র মানে? ফেসবুক থেকে