প্রকাশিত: Wed, Mar 29, 2023 10:03 AM
আপডেট: Wed, Jun 25, 2025 11:24 PM

ভাঁড় এবং শিল্পী কে?

আহসান হাবিব[১] ভাঁড় এবং শিল্পী কেÑ যারা পার্থক্য করতে জানে না, তাদের কাছ থেকে সংস্কৃতি বিষয়ে ছাইপাঁশ প্রসব হবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে এখন ভাঁড়ের জয়জয়কার। [২] বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিপরীতে প্রলেতারীয় সংস্কৃতি কি তা শনাক্ত করতে না পারলে লুম্পেন সংস্কৃতিকেই মনে হবে নিম্নবর্গের সংস্কৃতি। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি কি করে শিল্পে প্রকাশ করা যায়, তা একটি কঠিন কাজ। বের্ট্রোল্ট ব্রেখট আবিষ্কার করেছিলেন এপিক ধর্মী থিয়েটার। এর সহজ মানে হচ্ছে বুর্জোয়া শিল্প যেখানে মানুষকে ঘটনায় বুঁদ করে রাখে, এপিক সেই অবশতাকে ভেঙে সচকিত করে তোলে, প্রতিবাদী করে তোলে। [৩] বুর্জোয়া সংস্কৃতি ভোগের, ব্যক্তির। শ্রমজীবী মানুষ টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত।

এর রাজনৈতিক মুক্তি নিহিত আছে ভোগের ব্যক্তিক থেকে সামাজিক করে তোলায়। প্রলেতারীয় সংস্কৃতি যদি বুর্জোয়া সংস্কৃতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা উন্নত না হয়, তাহলে তা ওই সংস্কৃতিকে হটিয়ে নিজেকে স্থাপন করতে পারবে না। কারণ উচ্চ সংস্কৃতিই কেবল নিম্ন সংস্কৃতির জায়গা দখল নিতে পারে। এর রাজনৈতিক রূপ হচ্ছে প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। [৪] বাংলাদেশে তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা নিজেদের সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা ঢাকে ভাঁড়দের উত্থানের বগলের নীচে। তাদের ক্ষুদে মানসিকতার পরিতৃপ্তি হয় এই সকল নিম্নরুচীর ভাঁড়াটেপনায়। ফলে নিম্নবর্গের বা শ্রমজীবী মানুষের সাংস্কৃতিক রূপায়নের শিল্পরূপ সম্পর্ক বকলম থেকে বর্জ্য উৎপাদন করতে থাকে। এবং এই বর্জ্যেই তারা মুখ গুঁজে তৃপ্তি খোঁজে।

[৫] শিল্প হচ্ছে রাজনীতির সাংস্কৃতিক প্রকাশ। সংস্কৃতি রাজনীতিকে বেগবান করতে পারে, কিন্তু রাজনীতি না থাকলে সংস্কৃতি এককভাবে কিছু করতে পারে না। এটা পারস্পরিক। বাংলাদেশে বাম রাজনীতির যে সাংস্কৃতিক ফন্টগুলি ছিলো, আজ তা প্রায় চোখে পড়ে না। সেসব জায়গা দখল করেছে ধর্মীয় পশ্চাদপদ গোষ্ঠী। তাদের একটাই কাজ সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। এটা কেন হলো? এটা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের মধ্যেই আছে। ৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিবিপ্লবীদের হাতে গিয়ে পড়ে। তারা দীর্ঘ সময় এদেশকে ভাবাদর্শগত পেছনে নিয়ে যেতে যেতে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে সেখান থেকে আর প্রগতিশীল ধারায় ফেরা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে বাম ধারার রাজনীতি সঙ্কুচিত হতে হতে এখন বিলোপের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে আওয়ামীলীগ তার সেই প্রগতিশীল চরিত্র খুইয়ে এখন কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যস্ত। এই দল যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, প্রতিবিপ্লব এবং চেতনার প্রাকৃতিক ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার ফলে এখন তার দেয়ার তেমন কিছু নেই। ফলে রাজনীতি দেউলিয়াত্ব প্রাপ্ত হয়ে পড়েছে। রাজনীতির এই দেউলিয়াত্বের কালে সংস্কৃতি কি করে তার উৎকর্ষ ধরে রাখে? চলে গেছে লুম্পেনদের হাতে। 

এই লুম্পেনরাই এখন সংস্কৃতির ভাঁড় হিসেবে দিয়েছে। আর যারা আধুনিক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকে একটা শিখরে নিয়ে গেছিলেন, তারা আজ কোণঠাসা, ক্ষয়িষ্ণু। কে পারে এসব ঠেকাতে? একটি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিই পারে কেবল সেই সংস্কৃতির ধারাকে বেগবান করতে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে দেখছি যারা বাম বলে পরিচিত তারাও সাম্প্রদায়িক শক্তির ধামাধরা ব্যর্থতাটা রাজনীতির, সংস্কৃতির নয়। লেখক: ঔপন্যাসিক