প্রকাশিত: Sat, Apr 8, 2023 2:56 PM
আপডেট: Wed, Jun 25, 2025 3:25 AM

রমজানে হৃদরোগীদের জীবন যাপন ও স্বাস্থ্য পরামর্শ

ডা. এস এম ইয়ার ই মাহাবুব : [২] রমজান বিশ^ব্যাপী মুসলমানদের জন্য পবিত্র রোজার মাস। এটি এমন একটি নিয়ম যখন রোজাদার মুসলমানরা ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং অন্যান্য শারীরিক চাহিদা থেকে বিরত থাকে। এটি একটি ফরজ ইবাদত, যা শারীরিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বাসী মুসলমানদের মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের সুযোগ করে দেয়। তবে  হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য রমজানে রোজা রাখা কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। একজন হৃদরোগী কীভাবে এসব ঝুঁকি এড়িয়ে রোজা থাকতে পারে নীচের আলোচনা থেকে এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাবে। 


[৩] হৃদরোগ বলতে হৃদপিণ্ড, বিশেষ করে এর রক্তনালীর মধ্যে চর্বির স্তর জমে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং তা থেকে উদ্ভুত কয়েকটি রোগকে বোঝায়। করোনারি আর্টারি ডিজিজ, হার্ট ফেইলিওর এবং অ্যারিদমিয়ার মতো রোগগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। রোজা থাকাকালে সারাদিন উপবাসের ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে, রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে  এবং রক্তচাপ কমে যেতে পারে, যা হৃদরোগীর রোগের লক্ষণগুলোকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই, হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রমজানে রোজা রাখার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা অপরিহার্য।


[৪] চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন : হৃদরোগে আক্রান্ত একজন যিনি রমজান পালন করতে চান তার জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হলো তার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা।  ডাক্তার রোগীর অবস্থা মূল্যায়ন করবেন এবং রোজা রাখা নিরাপদ কি না সে বিষয়ে পরামর্শ দেবেন।  যদি ডাক্তার রোজা রাখা নিরাপদ মনে না করেন, তবে রোগীকে তাঁর পরামর্শ অনুসরণ করা উচিত। আর যদি ডাক্তার পরামর্শ দেন যে রোজা রাখা নিরাপদ, তবে রোজায় রোগীকে তার নিজের  অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তাকে নিয়মিত নিজের রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করা উচিত এবং একটি ডায়েরিতে লিখে রাখা উচিত। যদি রোগীর  অ্যারিদমিয়া বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন থেকে থাকে, তবে তাতে কোনো পরিবর্তন হলে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং প্রয়োজনে ডাক্তারকে জানানো উচিত।


 [৫] নির্দেশিত ওষুধ সেবন করুন : হৃদরোগীরা সাধারণত তাদের শরীর ও হার্ট ভালো রাখার জন্য নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে থাকেন। রমজান মাসে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া অপরিহার্য। ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ না করে তাদের ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা বা ডোজ পরিবর্তন করা একেবারেই উচিত নয়। ডায়াবেটিসের রোগী তার ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও এর ব্যবহারের সময় পরিবর্তন করে নিতে হতে পারে। 


[৬] সাবধানে খাবারের পরিকল্পনা করুন : রোজাদারেরা সাধারণত রমজানে দু’টি খাবার খায়, সেহরি ও ইফতার।  এই খাবারগুলো যাতে  পর্যাপ্ত পুষ্টি এবং সারাদিনের পানির চাহিদা পূরণ করে তা নিশ্চিত করার জন্য সাবধানতার সঙ্গে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।  কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, প্রোটিন এবং চর্বি সহ খাবারগুলি সুষম হওয়া উচিত। ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা রোধ করতে ইফতারের সময় ও পরে প্রচুর পানি এবং অন্যান্য তরল পান করাও গুরুত্বপূর্ণ।


[৭] উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন : রমজান মাসে বেশির ভাগ লোক ইফতার এবং সেহরির সময় উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং  উচ্চ চিনিযুক্ত খাবার খেয়ে থাকে। এই খাবারগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে এবং ওজন বাড়াতে পারে, যা হৃদরোগকে আরও জটিল  করে তুলতে পারে। অতএব, এই খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এগুলোর পরিবর্তে  ফল, শাকসবজি এবং সেঁকা রুটি, অল্প ভাত, মাছ, মুরগির মাংস, ডিম ও ক্রিম ছাড়া দুধের মতো স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া অপরিহার্য।


[৮] ব্যায়াম : রমজানে রোজাদার হৃদরোগী ব্যক্তিদের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। তবে এ সময়ে কঠোর ব্যায়াম করা উচিত নয়। বরং বিকালে হাল্কা ব্যায়াম করে ইফতারের পরে বা তারাবি নামাজের পরে রোগীর অভ্যাস অনুযায়ী ব্যায়াম করা উচিত। তাছাড়া তারাবি নামাজ পড়লে এটি থেকেও একটি ব্যায়ামের উপকার পাওয়া যায়। 


[৯] বিশ্রাম : রমজান মাসে বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে হৃদরোগীদের জন্য। কর্মরত অবস্থায় বা গরমে অস্বাভাবিক ক্লান্তি  বোধ হলে সাময়িক  বিরতি এবং বিশ্রাম নেওয়া উচিত। তাদের কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন এবং সকালে হঠাৎ তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠা উচিত না, কারণ এটি তার সারাদিন ক্লান্তির কারণ হতে পারে। তাছাড়া এ থেকে প্রেশার ও হার্টের অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে যেতে পারে।


[১০] বিশেষ সাবধানতা : রমজানে রোজা থাকা অবস্থায় যদি রোগীর বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরার মতো কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে তার অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এই লক্ষণগুলো অবজ্ঞা করা উচিত না, কারণ এগুলো গুরুতর কোনো সমস্যার শুরু হতে পারে, যার জন্য জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন।


[১১] শেষ কথা : রমজানে রোজা রাখা হৃদরোগীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে সাবধানে পরিকল্পনা করে এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে  নিরাপদে রোজা রাখা সম্ভব। রোগীর রোজা রাখার আগে তাদের ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত, তাদের অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত, নির্ধারিত ওষুধ সেবন করা উচিত, তাদের ইফতার ও সেহরি খাবারের পরিকল্পনা করা, ব্যায়াম করা, বিশ্রাম নেওয়া এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই পরামর্শগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করে, হৃদরোগে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি  তার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বজায় রেখে নিরাপদে রমজান পালন করতে পারে।


লেখক: ইন্টারভেনশনাল ও ক্লিনিক্যাল কার্ডিওলজিস্ট, সিসিডি (বারডেম), সহযোগী অধ্যাপক, বিএসএমএমইউ