আহসান হাবিব:  ‘রেজিম চেইঞ্জ’ শব্দটি বেশ শুনতে পাচ্ছি। বেশ ভারী রাজনৈতিক শব্দ। এর মানে যা আমি বুঝি তা হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের পরিবর্তে অন্য একটি দলকে ক্ষমতায় বসানো। কারণ এই সরকার অনেকদিন ধরে ক্ষমতায় বসে আছে, স্বৈরাচার হয়ে উঠেছে, দুর্নীতি, লুটপাট, গুম, খুন, টাকা পাচার ইত্যাদিকে মেতে উঠেছে। সত্য, অভিযোগ সত্য। সূতরাং রেজিম চেইঞ্জ করা দরকার। কিন্তু দরকার বললেই তো চেইঞ্জ হয়ে যায় না। চেইঞ্জ করার যে নিয়ম সেই নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে হয়। কারা হাঁটবে? রাজনৈতিক দলগুলি। কারণ জনগণ সরাসরি রেজিম চেইঞ্জ করতে পারে না, তারা রাজনৈতিক দলের হয়ে হয় নির্বাচন কিংবা গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে রেজিম চেইঞ্জ করে, এই উদাহরণ বাংলাদেশে আছে, অন্যত্রও আছে।

এখন দেখা যাক রাজনৈতিক দলগুলো এই সরকারের বিরুদ্ধে কোন গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে কি না। পারেনি। গণআন্দোলন তো দূরের কথা, আন্দোলনই গড়ে তুলতে পারেনি, এমনকি নির্বাচনে ঠিকমত অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দায় চাপিয়ে নিজেদের মুক্তি দিতে চেয়েছে। রাজনৈতিক দল যদি তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই করতে ব্যর্থ হয়, জনগণ কি করতে পারে? তারা কি নিজেরা মাঠে নেমে পড়বে? এটা হাস্যকর। আমাদের দেশে আবার অনেকেই জনগণের উপর দোষ চাপায়। চাপিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে দায়মুক্ত করতে চায়। খুবই হাস্যকর অভিযোগ। রেজিম চেইঞ্জ হলে সম্ভাব্য কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারে?

এক কথায় বিএনপি। কারণ বিএনপি ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে না, সেই জনভিত্তি অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নেই। তাহলে এটা স্পষ্ট যে যারা রেজিম চেইঞ্জ চান, তারা বিএনপি ক্ষমতায় আসুক এটাই চায়। তাহলে এই কথাটি সোজাসুজি বললেই হয় এবং বিএনপি’র পক্ষে নেমে আন্দোলন গড়ে তুললেই হয়। কিন্তু সেই কাজ করতে হলে তো জনগণকে প্রস্তুত করতে হবে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। আওয়ামীলীগ যদি স্বৈরাচার হয়, তাহলে তো জনগণকে সংগঠিত করা আরো বেশি দরকার। এমনি এমনি তো রেজিম চেইঞ্জ হয়ে যাবে না।

আর একটি পদ্ধতিতে রেজিম চেইঞ্জ হয়, সামরিক সরকার যদি ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু তারা ক্ষমতা দখল করেনি, করবে এমন কোন আলামতও দেখি না। আর একটি পদ্ধতিতে রেজিম চেইঞ্জ হতে পারে- বিপ্লব। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোন বিপ্লবী দল দেখি না যারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রেজিম চেইঞ্জ করে ফেলবে। এখন প্রশ্ন- যারা রেজিম চায়, তারা কারা? আগেই বলেছি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ জোট ছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলি সবাই। স্বাভাবিক এই চাওয়া। কিন্তু চাইলেই হবে? তার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে, সঠিক কর্মসূচি থাকতে হবে, সর্বোপরি থাকতে হবে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবী। একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে বলে তাকে চেইঞ্জ করা দারকার- এমন ছেলেমানুষি দাবী হাস্যকর।

একদল মানুষ আছে যারা মনে করে আওয়ামী লীগ করা কিংবা সমর্থন করা অপরাধ। কেন ভাই? আপনার দল করলে সেটা পুণ্যের কাজ কি করে হয়, তা মাথায় আসে না। আবার আওয়ামীলীগ সমর্থিত যারা বুদ্ধিজীবী আছে, তাদের দালাল বলা হয়, কেন ভাই? আপনার দল করলে কি করে নবী হওয়া হয়, তা মাথায় আসে না। প্রতিটি মানুষ তার নিজের রাজনীতি করবে। প্রতিটি বুদ্ধিজীবী তার নিজের রাজনীতি করবে। অনেকে মনে করে বুদ্ধিজীবীদের কোন রাজনীতি নাই, এদের কাজ যে যখন ক্ষমতায় থাকবে তার বিরুদ্ধে বলবে এবং বিরোধীদলকে ক্ষমতায় বসানোর কাজ করে যাবে! এসব খুবই হাস্যকর দাবী। যদি তাই হয়, তাহলে তো বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দায় হচ্ছে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য সমস্ত বুদ্ধি ব্যয় করা, নইলে তাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে কোন মান থাকে না।

যে কোন সরকারের কাজের সমালোচনা করার অধিকার আছে সব মানুষের। সমালোচনা করা এক জিনিস আর রেজিম চেইঞ্জ করা আলাদা বিষয়, সেটি করার জন্য রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করতে হয়। সরকার স্বৈরচার হয়ে উঠলে গণআন্দোলনের পথ তো খোলাই আছে। স্বৈরাচারী এরশাদকে কি এই রাজনৈতিক দলগুলিই গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেনি? করেছে।

এখন যদি রেজিম চেইঞ্জ মানে যদি আওয়ামীলীগকে সরিয়ে বিএনপিকে বসানো হয়, তাহলে তো যেই লাউ সেই কদু। এখন পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনলাম না বিএনপি ছাড়া তারা অন্য কোন আরো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের হাতে দেখতে চায়। সবাই চাইছে যেন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় না থাকে, সেটা যদি বিএনপি জামায়াত হয়, ক্ষতি নাই। আসলে তারা এটাই চাইছে। তাহলে তো এটা রেজিম চেইঞ্জ হলো না ভাই, নিজেদের পছন্দমতো দলকে ক্ষমতায় বসানো হলো! আমি চাই এমন রেজিম চেইঞ্জ যার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা যাবে একটি আধুনিক প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দলের হাতে। হায়, এমন দল বাংলাদেশে একটাও নাই। লেখক: ঔপন্যাসিক