
প্রকাশিত: Tue, Dec 13, 2022 5:25 PM আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 11:08 AM
এতোদিনেও কেন বুদ্ধিজীবীদের তালিকা হলো না?
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
[২] আজকাল আমরা কথায় কথায় অর্গানিক ফুডের কথা বলি। অর্গানিক ফুড মানে হচ্ছে, বিশুদ্ধ খাবার। একাত্তরে যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিলো, তারা ছিলেন আমাদের অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও ফ্রাঞ্চেস্কো গ্রামশি তাঁর প্রিজন নোটবুকস-এ অর্গানিক বুদ্ধিজীবীদের কথা বলেছিলেন।
[৩] একটি ভ্রান্তি আছে আমাদের জাতীয় জীবনে। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি আমরা। কিন্তু আমার মনে হয়, পাকিস্তানিরা ‘মোটা মাথা’র হলেও বাঙালি দোসরদের পরামর্শে ২৫ মার্চ থেকেই তারা বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করেছিলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরেই চলেছিলো বুদ্ধিজীবী নিধন। ২৫ মার্চ থেকে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
[৪] আমাদের এইসব অর্গানিক বুদ্ধিজীবী যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধুর হাত আরও শক্তিশালী হতো। কারণ বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ পেয়েছিলেন, সেটি ছিলো ধ্বংস্তূপ। তখন যারা বুদ্ধিজীবী ছিলেন তারা সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিতে পারেননি। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে ভালো পরামর্শ দিতে পারতেন। অন্তত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রিক যতো বুদ্ধিজীবী নিধন বা শহীদ হয়েছেন, তাদের সবার সঙ্গেই আমি ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলাম। তাদের চিন্তা-চেতনা আমাকে প্রভাবিত করতো।
[৫] বিশেষ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তিন শহীদ শিক্ষকের কথা বলতে পারি। আমাদের সবার শিক্ষক ছিলেন সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য। সৌম-দর্শন আমরা বলতাম। খাঁটি গ্রাম্য। সেই শিক্ষকটি আমাদের বিভাগের প্রতিটি শিক্ষকের শিক্ষক ছিলেন। কাজেই তিনি ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ড. আবুল খায়ের চুপচাপ থাকতেন। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো তিনি চুপচাপ থাকতেন। যখন একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন চলে, ওই সময়ে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভারে ড. আবুল খায়েরের একগুচ্ছ লেখা দেখে আমি বুঝেছিলাম, তিনি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। যাকে ১৪ ডিসেম্বর আমার চোখের সামনে থেকে মহসিন হলের ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। আমি আজও স্মরণ করি, তাদের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শ্রেণিকক্ষে। তারা বইয়ের পাতা থেকে কালো অক্ষর উগড়ে দিতেন না শুধু, দেশ ও সমাজের জন্য কথা বলতেন। আমি এখনো তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।
[৬] বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কতো? এ ব্যাপারে সরকারিভাবে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। কাজটি করা উচিত ছিলো মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে। তবুও আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত সংখ্যা পেলাম না। রাজাকারদের সংখ্যাও পেলাম না। পেলাম না বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাও। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ১৩ জন সাংবাদিকের ওপরে একটি বই ছেপেছে। কাজটি তারা অত্যন্ত ভালো করেছে বলে আমার মনে হয়। গণমাধ্যম থেকে আমি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তথ্য সংগ্রহ করেছি, ১ হাজার ১শ এগারো জন বুদ্ধিজীবীর। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো তথ্য পাচ্ছি না। আমরা অপেক্ষায় থাকবো, অন্তত এই কাজটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় করুক।
[৬] আমি যখন বাংলা একাডেমির দায়িত্ব পালন করি, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১। সেই সময় বাংলা একাডেমির একটি মুক্তিযুদ্ধ প্রকল্প ছিলো। জেলাভিত্তিক ইতিহাস হবে। আমাদের নির্দেশ ছিলো, প্রতিটি জেলার যে ইতিহাস, তার পরিশিষ্টে থাকবেÑশহীদ বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। রাজাকারের সংখ্যা। ৪৭টি কপি তৈরি হয়েছিলো। ছিলো এসব। এরপর আমার দায়িত্বকাল শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমার ধারণা ছিলো, মুক্তিযুদ্ধ প্রকল্পটি সরকার চালিয়ে নেবে। কিন্তু সরকার সেই প্রকল্পটি চালায়নি। কাজটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ছিলো। যে কারণে আজ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আমরা পাইনি।
[৭] শহীদ বুদ্ধিজীবী কিংবা গণহত্যার কথা বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কখনো তৈরি হতে পারে না। আমি মনে করি, আমাদের করণীয় অনেক কিছুই ছিলো, কিন্তু আজও করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের সুবিধা আমরা ভোগ করছি, স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছি। কিন্তু করণীয় অনেককিছুই আমরা করতে পারিনি। এটা বেদনাদায়ক।
[৮] বুদ্ধিজীবীদের আমরা স্মরণ করি শুধু একটি দিনই, ১৪ ডিসেম্বর আর সারাবছর তাদের উপেক্ষা করি। কারণ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে যতোগুলো স্থাপনা আছে, শুধু ১৪ ডিসেম্বরের আগে একটু ঝাড়ু-মোছা দেওয়া হয়, আর সারা বছর অবহেলায়-অনাদরে পরে থাকে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা কতো তার তালিকা এখনো আমরা পাইনি সরকারের পক্ষ থেকে। বিএনপি-জামায়ত এই তালিকা করবে, তা আশা করি না কিংবা উচিতও নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ১৩ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় আছে, এতোদিন তারা কী করলো? বুদ্ধিজীবীদের তালিকাটা তৈরি করতে পারলো না কেন?
[৯] বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের চেহারা আজ অন্যরকম হতো। যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন আমার শিক্ষক ছিলেন। তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো, তাদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গেও পরিচিত ছিলাম, তারা আজকের এই বাংলাদেশ দেখতে চাইতেন না। আমার মনে হয়, নীতিনির্ধারকদের কেউ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে যতোটা সচেতন থাকার কথা ততোটা সচেতন নন। বুদ্ধিজীবীদের কদর বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে এমনিতেই কম। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
[১০] শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত। একইসঙ্গে তাদের জীবনীগ্রন্থও প্রকাশ করা প্রয়োজন। এই দায়িত্ব বাংলা একাডেমিকে দেওয়া যেতে পারে। তবে তাদের কিছু কিছু জীবনী লেখা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সরকারিভাবে জাতীয় পর্যায়ে তাদের জীবনী রচনার একটি উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিলো, সেটা হয়নি। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করবার জন্য আমাদের পাঠ্যপুস্তকে তাদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর জীবনী যেমন অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, তেমন বুদ্ধিজীবীদের জীবনীও অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। আমাদের কোনো রকমের চর্চায় বুদ্ধিজীবীদের দেখি না, সাংস্কৃতিক চর্চা হোক কিংবা রাজনৈতিক চর্চা হোক, তাদের যতোটুকু চিনেছি, বুঝেছি তাদের চিন্তা চেতনার কোনো প্রতিফলন দেখি না।
[১১] আজকের বাংলাদেশে ধর্মান্ধ এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আস্ফালন চলছে, এই বাংলাদেশ তো শহীদ বুদ্ধিজীবীরা চাননি। এই বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে অপরাজনীতির কারণে। এই অপরাজনীতি বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-চেতনার বাইরে ছিলো, তারা রাজনীতি বলতে জনকল্যাণ বুঝতেন। রাজনীতি বলতে, তারা প্রগতি বুঝতেন। পরিচিতি : ইতিহাসবিদ
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
