প্রকাশিত: Thu, Dec 15, 2022 4:31 AM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 12:45 PM

খেলা খেলা নয়, আরও অনেক কিছু!

আব্দুন নূর তুষার

ফুটবলের মতো খেলা বহু আগে থেকে ছিলো। একসময় নরমুন্ডু দিয়ে এই খেলা হতো। আজটেক সভ্যতায় একধরনের ল্যাটেক্স বল দিয়ে একটা খেলা খেলতো। খেলা শেষে বিজয়ী দলের দলনেতাকে দেবতা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে শিরচ্ছেদ করে ফেলতো। এতে গরিব দলনেতা রাজি হতো। কারণ এই মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার অভিজাত পরিবারের মর্যাদা পেতো। সম্পদ পেতো। আধুনিক ফুটবল গরিব শ্রমিকদের খেলা। এজন্যই দলের নাম ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল। ক্রিকেটের মাঠের নাম লর্ডস। দলের নাম মেরিলিবোর্ন আর সাসেক্স। মিডলসেক্স। ফুটবল হলো ওয়েম্বলি। এখনো এতো উন্নয়নের পরেও বাড়িভাড়া লন্ডনের এভারেজ ভাড়ার অর্ধেক। বড়লোকদের শহরেও অপেক্ষাকৃত সস্তা এলাকা। ফুটবল তাই সারা বিশ্বের খেলা। ক্রিকেট ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা দেশগুলোর খেলা। সাহেব হবার আকাক্সক্ষা থেকে খেলা। ফুটবল খেলে সাহেব হওয়া যায় না। ফিফা মূলত অ্যামেচার ফুটবল এসোসিয়েশন। কিন্তু বিশ্বকাপে জাতীয় দল খেলে প্রফেশনালদের সাথে নিয়েই। আগে এতো টাকা ছিলো না ফিফার। ব্রাজিল থেকে আসা ফিফার সভাপতি জোয়াও হাভালাঞ্জ সেপ ব্ল্যাটারকে সেক্রেটারি নিয়োগ দেন টাকা বা স্পন্সর আনার ইচ্ছা থেকে। ব্ল্যাটার কোকাকোলাকে নিয়ে আসেন। কাপটা হয়ে যায় কোকাকোলা কাপ। এরপর আরো আসে এডিডাস। তারপর অন্যরা। 

ফিফার শুধু টাকা আর টাকা। এডিডাসের মালিক একটা টিভি রাইটস কোম্পানি বানান আর হাভালাঞ্জরা মিলে এটাকে ফুটবল রাইটস দিয়ে পয়সা বানাতে থাকেন। একটা মাত্র কোম্পানি ফিফার সব রাইটস কুক্ষিগত করে রাখে আর ফ্রেড ডাসলার স্পোর্টস ব্রডকাস্ট জগতে মাফিয়ারাজ কায়েম করেন। যে ডিকোডার দিয়ে এনক্রিপটেড ব্রডকাস্ট সিগন্যাল ডিকোডিং করতে হয় সেটাও একটা ইসরাইলি কোম্পানির একচেটিয়া মনোপলি। মধ্যপ্রাচ্যর হাম্মাম আর আমেরিকার চাক ব্লেজার ও কনকাকাফ-এর জ্যাক ওয়ার্নার মিলে ফিফাকে ঘুষ ও কমিশনের রাজত্ব বানিয়ে ফেলেন। এরা ছিলেন দালাল। আসল নাটের গুরু সেপ ব্ল্যাটার নিজেই। একেকবারে ভোট কেনাবেচা হতো এক মিলিয়ন দেড় মিলিয়ন ডলারে। একপর্যায়ে তাঁরা ভবিষ্যতের টুর্নামেন্ট বেচতে থাকেন। সেই টাকা এনে খরচ করতে থাকেন। কাতার বিশ্বকাপ নিয়েও ঘুষের খেলার অভিযোগ আছে। তাই এতো হাসিখুশির পেছনে অনেক চুরি ঘুষ দুর্নীতি আছে। প্লাটিনি সহ অনেকে বেঁকে বসলেও ২০২২ এর আসর আমেরিকা হোস্ট করতে চেয়ে না পাওয়ায় দুর্নীতি চক্রে অন্তর্কোন্দল দেখা দেয়। হাম্মাম ও লিসা হায়াতু প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে ব্ল্যাটার নিজে তাদের ঘুষের তথ্য লোক দিয়ে ফাঁস করিয়ে দেন। পরে নিজেও ধরা খেয়ে যাবার ভয়ে পদত্যাগ করেন। 

ফিফা খুব গণতান্ত্রিক। বাংলাদেশ খেলতে পারে না, কিন্তু ভোটের বেলায় ব্রাজিলের এক ভোট বাংলাদেশেরও এক ভোট। তাই ভোটের সময় এশিয়া, আফ্রিকা, ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর ভোট কেনা বেচা হয়। এজন্যই গরিব দেশের ফেডারেশনের নেতা কিছুতেই পদ ছাড়তে চায় না। লক্ষ্য করবেন। এই বিশ্বকাপে কোথাও হাম্মাম বা ব্ল্যাটারের চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এশিয়ায় ও আফ্রিকায় ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনে এই দুজনের বিরাট অবদান আছে। ঘুষ, চুরির পরেও আছে। যাই হোক। ওপরে যতোটা আনন্দ ভেতরে ততোটা সাদা না। এই বিশ্বকাপে নানা রকম রাজনীতিও আছে। কেউ মুখে হাত দেয়, কেউ মাল্টিকালার রিবন চায়, কেউ প্যালেস্টিনের পতাকা ওড়ায় আর কেউ গণতন্ত্র চায়। কেন? কারণ ফুটবলই সারা পৃথিবীর একমাত্র খেলা যা সবখানে জনপ্রিয়। অন্য কোনো খেলার এতো দর্শক নাই। জালে বল ঢুকলে গোল। এতটুকু বুঝলেই আপনি দর্শক হতে পারবেন। এই খেলায় এলবিডব্লিউ টাইপের আইন নাই যেটা বোঝাতে একটা ছোট বই লিখতে হয়। ডাকওয়ার্থ লুইস নাই। আছে সহজ সরল টাইব্রেকার।

 বিশ্বকাপ এখন শেষের দিকে। আর চারটা খেলা। তারপর আবার চারবছর। এবার রোনাল্ডো আর নেইমার আগেই নেই। তাই মেসির জন্য আর দুটো খেলা বাকি। পৃথিবী এখন আর্জেন্টিনার পক্ষে। দিনশেষে মানুষ যোগ্য খেলোয়াড়ের হাতেই কাপ দেখতে চায়। আর সে যদি হয় মেসি, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। এই রকম ১৯৮২ সালে সবাই কাপ দেখতে চেয়েছিল সক্রেটিসের হাতে। ডাক্তার ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। ব্রাজিলের স্বৈরাচারবিরোধী রাজনীতির পক্ষে জার্সিতে ডেমোক্রেসি লিখেছিলেন। স্বৈরশাসক তাই বলে তাকে খেলতে বাঁধা দেয় নাই। কারণ কাপ পেলে ক্রেডিট স্বৈরশাসকই পেতো। এটাকে বলে স্পোর্টস ওয়াশিং। খেলাধুলার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে নিজেদের কুকাজ ভুলিয়ে রাখা হয় জনগণকে। কে জানে হয়তো এজন্যই যে খেলা ড্র করলেও হয় সে খেলা তিন দুইতে হেরে যায় ব্রাজিল। পাওলো রসির গোলে শেষ হয়ে যায় ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দলের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। ইচ্ছা করেই কি স্বৈরশাসককে ক্রেডিট দেয় নাই সেই দল? কেউ জানে না। জিকো ফ্যালকাও সক্রেটিস অস্কারের ব্রাজিলয়ের সেই দল ফুটবল খেলতো যে ছন্দে, সেই ছন্দ আর ফিরে পায় নাই এই ব্রাজিল দল। জুয়াড়ীদের ষড়যন্ত্রে জেল খাটা পাওলো রসি আপিল করে একবছর আগেই নিষেধাজ্ঞা শেষ করে ফিরে এসে ব্রাজিলকে শুধু বধ করেন নাই, তিনি তখন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার হয়ে গিয়েছিলেন। ইতালি এ বছর কোয়ালিফাই করে নাই। এতো গল্পের কারণ কি? কারণ এতো কিছুর পরে আমরা দর্শকরা এখনো জুলিয়াস সিজারের কলোসিয়ামেই আছি। ফুটবলাররা গ্লাডিয়েটয়ের মতো বেচাকেনা হন। রাজা-বাদশাহরা পয়সা ও ক্ষমতার প্রদর্শনী করে। আমাদের নায়ক মেসি-রোনাল্ডো-নেইমাররা প্রস্থান করেন। আমরা দুঃখ পাই হাসি কাঁদি। লড়াই করি নিজেরা নিজেরা। 

আর বাংলাদেশে তমা কনস্ট্রাকশন বিটিভির কাছে ৯৮ কোটি টাকায় বিশ্বকাপের রাইট বেচে। যে বিশ্বকাপ অন্যান্য বছর ফ্রি পেয়েছিলো বিটিভি। আমরা কলোসিয়াম থেকে বের হয়ে যাবো আর এক সপ্তাহ পরেই। কিন্তু আমাদের খেলা নিয়ে রাজনীতি ও টাকার খেলা চলবে। মেসি-রোনাল্ডো-নেইমার-পেপে-এমবাপেরা আসবে যাবে। এরা হলো প্রোডাক্ট। এরা গ্লাডিয়েটর। ম্যারাডোনার মতো হঠাৎ হারিয়ে যাবেন। রোনাল্ডোর মতো অপমানিত হবেন। আত্মঘাতী গোলের অপরাধে কলাম্বিয়ান ড্রাগ কার্টেলের হাতে খুন হবে আনদ্রিয়াস এস্কোবারের মতো। তাকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছিলো যে পাবলো এস্কোবার। সেও নাই। খতম। অথচ টিকে আছে দেশে দেশে এখনো নানা রূপে স্বৈরশাসন ও দুর্নীতি। তাদের বিচার হয় না। আর ব্ল্যাটারদেরও কখনো বিচার হবে না। আমরা লুঙ্গির টাকা বাঁচিয়ে পতাকা বানাবো। আর এস আলমরা ব্যাংক খালি করবে। আমরা এখানে কৃচ্ছ্রতার গল্প শুনবো আর কারা যেন কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে যাবে দলেবলে। পুঁজির পৃথিবীতে টাকা আজ ঈশ্বর। এই পয়সা কড়ির জগতে আমরা শিকার। শিকারীরা দিনশেষে জিতে যায়। স্বৈরশাসন আর দুর্নীতিবাজরা খেলার মাঠেও একসঙ্গে থাকে। লেখক: মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ফেসবুক থেকে