প্রকাশিত: Sat, Dec 17, 2022 5:55 AM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 10:57 AM

আসুন, গাজীপুর কাপাসিয়ার মনোয়ারা বেগমের ‘গল্পটা’ আরও একবার শুনি

মোজাফফর হোসেন

যুদ্ধ তখন চলছে। মনোয়ারাকে নির্যাতন করে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেল পাকিস্তানি আর্মিরা। মনোয়ারা দিনের পর দিন বন্দি চারদেয়ালের মধ্যে। বাইরে যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, মনোয়ারা এসব কিছুই জানে না। জানে না তার মা-বাবা ভাইবোনের কেউ বেঁচে আছে কিনা। তাঁর বেঁচে থাকার যুদ্ধটা সে একাই করে যাচ্ছে, অন্ধকারে। মনোয়ারা বেঁচে আছে, দেশ একদিন স্বাধীন হবে, প্রতিদিন অমানবিক নির্যাতনের মধ্যে এই স্বপ্নটা হয়তো ওঁকে বাঁচিয়ে রাখে। মনোয়ারা বেঁচে থাকে, দেশ স্বাধীনও হয়। কিন্তু স্বাধীন দেশের বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয় না। যুদ্ধাক্রান্ত পরাধীন জীবন তার আর শেষ হয় না। যুদ্ধের শেষ দিকে, পরাজয়ের ইঙ্গিত টের পেয়েই কিনা কে জানে, এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ওকে দাস করে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। সেখানেও মনোয়ারার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। 

ক্যাপ্টেনের বন্ধুরা দলেদলে এসে অংশ নেয় নির্যাতকের ভূমিকায়। তারা হেরে গেছে বাঙালিদের কাছে, কিন্তু একজন বাঙালি নারীকে রেখে দিয়েছে নির্যাতন করার জন্য। এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কিন্তু না... পরে মনোয়ারাকে ফ্রান্সে চুক্তিভিত্তিক বিক্রি করে দেওয়া হয়। মনোয়ারা টের পায়, ভাষা বদলাচ্ছে, মানুষের চেহারা বদলাচ্ছে, কিন্তু ওর উপর নির্যাতনের মাত্রা কমছে না। কয়েক বছর পর ফ্রান্স থেকে আবার পাকিস্তানে আনা হয়। ততদিনে মনোয়ারার শরীরটা নির্যাতনের জন্য ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে গেছে। বয়স হয়েছে। এখন কি হবে? এবার তাকে পাকিস্তানের রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হলো। এদিকে সুদূরে পড়ে মনোয়ারার স্বপ্নের স্বাধীন দেশ। কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা সেই নারীটি আর নেই সে, ততদিনে মানসিকভাবে অসুস্থ। আধপাগল হয়ে পাকিস্তানের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই হয়তো কোনো দিন রাস্তায় মরে পড়ে থাকত বেওয়ারিশ লাশ হয়ে। আমরা কোনোদিনই জানতাম না একজন মনোয়ারার কথা। কিন্তু... একদিন সেখানে কয়েকজন বাঙালি ওকে দেখে।  মনোয়ারার মুখে বাংলা-উর্দু-ফরাসি মিশেলে কথা শুনে ওরা এগিয়ে যায়। বাংলাদেশি বুঝতে পেরে ওই বাঙালিরা ওকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।  সময়টা ২০০০ সাল। মাঝখানে মাঝখানে ঊনত্রিশ বছর চলে গেছে। মনোয়ারা কোনোমতে গ্রামের নামটি বলতে পারে। তা দিয়েই দেশে খুঁজে বের করা হয় তার পরিবারকে। দেশে ফিরে আসেন মনোয়ারা, স্বাধীন বাংলাদেশে। 

‘গল্পের’ শেষটা নিশ্চয় ভালো হতে পারত? কিন্তু না, হয়নি। দেশে মনোয়ারাকে তাঁর পরিবার সম্মানের সাথে গ্রহণ করেনি। কোনোমতে থাকার একটা জায়গা দিয়েছিল গরুছাগলের ঘরে। দেশে ফিরেও মনোয়ারা অমানবিক জীবন যাপন করেছে। সবসময় একা একটা বোরকা পরে থাকত। ভয়? অপরাধবোধ? কিন্তু কেন? আপনারা এর উত্তর জানেন। মনোয়ারা অবশেষে মুক্তি পান, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। দেশের মাটিতেই মিশে যায় মনোয়ারা শরীর, ওর স্বপ্নও। মনোয়ারা আমার মায়ের নাম, আমার জাতীয় পরিচয়পত্রে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম: মনোয়ারা বেগম। দুজন কি আলাদা নারী? এখন আলাদা কেমন করে করি? দুজনই তো মিশে আছেন বাংলার মাটিতে। তাদের শরীরটা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে আলাদা করব। আর আলাদা করার ইতিহাসকে তো আমি মনেপ্রাণে অস্বীকারই করি। মনোয়ারা, আপনাকে ভালোবাসি, আপনাকে ভালো না বাসলে এই মাটিকে ভালোবাসা যাবে না। আপনার জন্য কাঁদছি মনোয়ারা, আপনার জন্য আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেঁদে যাবো। এ যে আমাদের বিজয়ের আনন্দ। (মনোয়ারা সম্পর্কে জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধগবেষক সুরমা জাহিদের বই থেকে। কৃতজ্ঞতা সুরমা আপা)। লেখক: কথাসাহিত্যিক