
প্রকাশিত: Sat, Dec 17, 2022 5:56 AM আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 11:19 AM
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হবেন কারা?
শামীম আহমেদ
১৪ ডিসেম্বর আমরা শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করি শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। উদযাপন করি না বলে অবলোকন করি বলাই বোধহয় শ্রেয়। বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে সারাবছর অনেক জ্ঞানীগুণী নানা কিছু লেখেন, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করে পাঠকের মূল্যবান সময় নেব না। আমি ভাবছিলাম পাকিস্তান বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের ঘৃণ্য এই হত্যাযজ্ঞের কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে আজ আমরা কতটা পিছিয়ে গেছি! ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত ছিল। বাংলাদেশে অন্যায্য শাসন ও শোষণের ধারাবাহিকতার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মারপ্যাঁচে (বলছি ভারতের আধিপত্য বিস্তারের অভিপ্রায়ের কথা) বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানকে হারতেই হতো। না হারার জন্য যে মেধা, মনন ও দূরদৃষ্টির প্রয়োজন তা পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের কখনই ছিল না। নিজেদের উন্নত সম্প্রদায় ভেবে বাঙালির হাতে ক্ষমতা দেয়ার চাইতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভৌগলিকভাবে আধিপত্য হারানোকেও তারা শ্রেয় ভেবেছিল। আজও যদি আমরা বিশ্ব মানচিত্রে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করতে যাই তবে দেখব ১৯৭১ সালে তাদের যে পতনের শুরু, তা থেকে তারা কখনওই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কাছে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকিস্তান শুধু যুদ্ধের ময়দানেই হারেনি, হেরেছে মনস্তাত্বিকভাবেও। আগে যেখানে ভারত পাকিস্তানকে সমশক্তির সমরশক্তি বিবেচনা করা হতো, আজ তা কেবলই হারানো অতীত। সামরিক শক্তি ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে ভারত তো বটেই, পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের চাইতেও অনেক পিছিয়ে গেছে। পাকিস্তান বাহিনী তাদের হীনমন্যতার নিকৃষ্টতম নিদর্শন তৈরি করেছিল পুরো ১৯৭১ সাল জুড়ে বাংলাদেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করার মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলি খানের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় যুক্ত হয় বাংলাদেশেরই নাগরিক কিছু রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। যুদ্ধ শেষ হবার বহু আগেই রাও ফরমান আলিকে এই পরিকল্পনায় সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ। বেসরকারি বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গনতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে। এর পরপরই জহির রায়হান নিখোঁজ হন।
রাও ফরমান আলির খানের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার ঘটনায় যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকারও যে বিব্রত ছিল তার প্রমাণ মেলে তাকে সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কার করে তার সকল সামরিক ব্যাজ প্রত্যাহার করার মাধ্যমে। তবে জুলফিকার আলি ভুট্টোর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের আরেক সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৯ সালে তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ৪-৫ বছর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সেনা শাসকদের অভ্যুত্থান ও উত্থানের মধ্যে একটি আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয় দেশেই ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তিরা ক্ষমতায় ফেরে এবং উগ্রবাদের পুনর্জন্ম ঘটায়। এ বিষয়ে আরেকদিন বিস্তারিত লিখব। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অর্ধশত বছর পরে যদি আমরা আজকের বাংলাদেশের দিকে ফিরে তাকাই, তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পরিষ্কারভাবেই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীন মত প্রদানে সক্ষম ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ আমাদের সামাজিক, রাজনীতিক, ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন বিরল প্রায়। আগে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন সমাজের আলোকবর্তিকা, আজ সেখানে শিক্ষকতা পেশাটাই যেন পরিণত হয়েছে হঠকারিতা ও দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারখানায়। সবাই এমন তা বলছি না, তা ভাবার কোনও অবকাশও নেই। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে এই মাত্র ত্রিশ বছর আগেও যখন দেশের আন্দোলন সংগ্রামে রাস্তায় মানুষ সর্বাগ্রে পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, সেখানে এখন তারাই সরকারের লেজুড়বৃত্তিতে অংশগ্রহণ করে লাঠিয়াল বাহিনীর নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে। রাও ফরমান আলি মারা গিয়েছে প্রায় ১৮ বছর হলো, কিন্তু তার পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে বুদ্ধিজীবী শূন্য করার যে মহাপরিকল্পনা তার ফসল পেতে শুরু করেছে পরাজিত হানাদার বাহিনী।
বুদ্ধিজীবী দিবসে একদিকে যেমন আমরা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করব আমাদের জাতির মেধাবী সন্তানদের, নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেব পাকিস্তান সামরিক শাসক ও তার এদেশীয় শোষকেরা কীভাবে আমাদের বুদ্ধিহীন করার প্রয়াস চালিয়েছে; ঠিক একই সাথে আমাদের নিজেদের আজকের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও উপযুক্ত সময় এখন। এটি মনে রাখা জরুরি যে একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান থাকে এর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখান থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে নিজেদের বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে শুরু করে দেশে বিদেশে। আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নত দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলে শিক্ষকতা পেশার জন্য আবেদনই করা যায় না।
ন্যূনতম পিএইচডি পরীক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন এবং যোগদানের পূর্বে তাদের পিএইচডি সম্পন্ন করতে হয়। গাড়ি চালানোর জন্য যেমন সেই বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে, পরীক্ষা দিয়ে পাস না করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া অসম্ভব, তেমনি পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে সঠিকভাবে শিক্ষকতা পেশার দায় মেটানোও সম্ভব না। পিএইচডি সম্পন্ন করতে উত্তর আমেরিকার একেকজন শিক্ষার্থীর ৬-৭ বছর পর্যন্ত লেগে যায়, কারণ এই সময়কালে যে তাদের শুধু একটি অনন্য গবেষণা সম্পন্ন করতে শেখানো হয় তা নয়, বরং কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাদানে একজন কর্মজীবী হিসেবে যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে, সেসব বিষয়ে প্রস্তুত হবার জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। গবেষক হিসেবে কীভাবে গবেষণার জন্য অর্থবরাদ্দের প্রক্রিয়াসমূহ সম্পন্ন করতে হয়, তাও থাকে এই প্রক্রিয়ার অংশ। আমাদের দেশের শিক্ষকদের অনেকেই যেহেতু মাস্টার্স সম্পন্ন করেই শিক্ষক হয়ে যান, তারা এই প্রক্রিয়া ভালো করে জানেন না, ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে গবেষণার জন্য অর্থ জোগাড় করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না, ফলশ্রুতিতে তাদের ছাত্ররাও গবেষণার অলিগলিতে পদচারণা ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে ফেলে।
গবেষণা ও শিক্ষকতার প্রধান মানদণ্ডগুলো না পূরণ করেই যুগের পর যুগ চলছে দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কী অবস্থা তা এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। এই লেখায় কেউ হুট করে রাগান্বিত হবেন না দয়া করে। এটি বাস্তবতা, আপনি একে অগ্রাহ্য করলেও এটি বাস্তবতা হিসেবেই থেকে যাবে। বুদ্ধিজীবী দিবসে তাই নতুন বুদ্ধিজীবী তৈরি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনের উপর জোর দিতে হবে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতির মেধাবী সন্তানদের হারিয়ে আমরা যতোটুকু পিছিয়েছি, তা থেকে শিক্ষা নিয়েছি কতোটা? আজ থেকে ২০ বছর পরেও কি আমাদের অনুন্নত মেধাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার জন্য আমরা পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দায়ী করে দায় মেটাতে পারবো? নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে এখনই একটি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না তৈরি করতে পারলে আগামী দিনগুলোও আমাদের হা-হুতাশ করেই কাটিয়ে দিতে হবে। তাই এখনই সময়ে ভিন্নভাবনার মাধ্যমে জাতিকে উত্তরণের পথ বাতলে দেয়া। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। লেখক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
