প্রকাশিত: Sun, Dec 18, 2022 4:24 AM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 12:52 PM

ফুটবল যতোটা না খেলা, তার চেয়েও অনেক বেশি লীলা!

গোলাম সারোয়ার

অনেকে আছেন, সামাজিক মাধ্যমে অ্যাক্টিভ নন। মানে তারা হয়তো অন্যের লেখা, অ্যাক্টিভিটি দেখেন। নিজেরা কিছু লিখেন না। কালে ভদ্রে হয়তো হৃদয়ে দাগ কাটে তেমন কিছু শেয়ার করেন। কিন্তু সবার অন্তরেই নিয়ত ভাবনা কাজ করে। তবুও পৃথিবীতে অন্তঃমুখী মানুষের সংখ্যাই বেশি। আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিচিতজনদের ভিতরেও অন্তঃমুখী মানুষই বেশি। যেহেতু মানুষ স্বভাবত অন্তঃমুখী, সুতরাং কাছের এবং দূরের আমাদের পরিচিত এই মানুষগুলোর সাথে হয়তো বছরের পর বছর কথা হয় না। আমরা কখনো তাদের মুখোমুখি হলে আবারো উজ্জীবিত হয়ে উঠি। তাদের সাথে গড়ে উঠা স্মৃতিগুলো তখন উথলে উঠে। সম্পর্কটা আবারো জীবিত হয়ে উঠে। 

তো, এই সুযোগটা আবার অনেকের সাথে তেমন হয় না। আমাদের এমন বন্ধুবান্ধবও আছে যাদের সাথে সেই শিশুকালের পর আর একবারও কথা হয়নি। হয়তো দু’জন পৃথিবীর দু’প্রান্তে। উপলক্ষ্য নেই তাই কথোপকথন নেই। ভাবের আদান প্রদান নেই। হয়তো মৃত্যুর আগে তাদের কারো কারো সাথে আর একবারও কথা হয় না। অথচ তার সাথে হয়তো আপনার বহু স্মৃতি আছে। মনের বহু মিল ছিলো সেই প্রাইমারি জীবনে হয়তো। জীবনের কোন পর্যায়ে হয়তো জানলেন, ওমুক আজ মারা গেছে। ওমনি আপনার স্মৃতি উথলে উঠে, আহারে নলদিয়া মেলাতে তার সাথে একসাথে গিয়েছিলাম। সে আমাকে চকোলেট দিয়েছিলো, আমি দিয়েছিলাম বাঁশি। 

এই রকম বহু সম্পর্ককে উসকে দেয় বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছরে একবারও কথা হয়নি, এমন পরিচিত জনদের সাথেও খুনসুটির কারণে কথোপকথন হয়। দূর হয় শূন্যতা, রিনিউ হয় সম্পর্কগুলো। বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু কি একটি খেলা? না, এটি হলো সমস্ত বিশ্বের মানুষকে এক কাতারে আনার একটি প্ল্যাটফর্ম। আমি বারবার বার বলি, ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়। এটি যতটা না খেলা, তার চেয়ে আরো অনেক বেশি লীলা। এটি সংসার সাগরে আশার নাম। আমরা যেমন প্রতিনিয়ত আশার পিছনে ছুটছি, খেলায়ও আমাদের চোখ ছোটে ফুটবলের পিছনে পিছনে। 

আপনি কি জানেন, এই সামাজিক মাধ্যমেও এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ফলো করা মানুষ কে? না তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব নন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নন। একশ আটত্রিশ কোটি মানুষের দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন, এমনকি একশ বিয়াল্লিশ কোটি মানুষের দেশ চীনের প্রেসিডেন্টও নন। এই মুহূর্তেও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ ফলো করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। 

এটি রোনালদোর বন্দনা নয়। এটি হলো ফুটবল বন্দনা। ফুটবল আমাদের পৃথিবীতে মহাসমারোহে চার বছর পর পর আসে। মাস খানেকের মতো উন্মাদনা নিয়ে পৃথিবীকে ব্যস্ত রাখে। আমরা এই সময়ে ভুলে যাই রাজনীতির টানাপোড়েন, যুদ্ধ বিগ্রহ, অর্থনীতির ঐন্দ্রজালিকতা কিংবা সংসারের অভাব অনটন। এটি পৃথিবীর এক অভাবনীয় মঞ্চ। এখানে পৃথিবীর সব দেশকে থাকতে চেষ্টা করা উচিত। বাংলাদেশ গত একান্ন বছরে অনেক কিছু অর্জন করেছে। কিন্তু আমরা এর ভিতরে হারিয়ে ফেলেছি আমাদের মানবজাতির অভিন্ন আত্মা ফুটবলকে। অথচ নব্বই দশকেও এদেশের প্রতিটি গ্রামের হিরো মানে ছিলো গ্রামের, পাড়ার, মহল্লার কিংবা জেলার সবচেয়ে ভালো ফুটবলারটি। 

আমরাতো কতো অযথা কাজে টাকা ঢালি। কারণ আমাদের এখন অনেক টাকা। এ জাতির ডিএনএতে আছে ফুটবল। আমরা কি পারি না রাষ্ট্রের নতুন প্রজন্মকে ফুটবলে ফিরিয়ে নিতে? দেশে কোন ব্যাপক জনসম্পৃক্ত কোন খেলা কেন থাকবে না? যদি এরকম কিছু না থাকে তবে তরুণ প্রজন্ম কোথায় সময় বিনিয়োগ করবে? কোথায় আনন্দ পাবে? কোথায় দেহ গঠন করবে? কোথায় তাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে? একটি ব্যাপক জনসম্পৃক্ত ইভেন্ট যদি কোনো জাতির না থাকে তবেতো তাদের ভিতরে বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি হবে। আমরা নানা মতে পথে বিভক্ত, বিশ্বাসে ইজমে বিভক্ত। কিন্তু ফুটবল আমাদের এই সব বিভেদ মোচন করে দেয়।

আমরা তরুণদের খেলার স্বপ্ন দিতে পারছি না। অবকাঠামো দিতে পারছি না। সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। উৎসাহ দিতে পারছি না। পরিণামে তারা কোথায় সময় ব্যয় করছে? কেন দেশে ইভটিজিং বেড়ে যাবে? কেন দেশে সন্ত্রাস বেড়ে যাবে? কেন দেশে পরিশ্রম বিমুখ তরুণরা বেড়ে যাবে? কেন তারা এদেশে পারে না, অথচ বিদেশে গেলে এক একটা সেরা হয়ে ফিরে আসে? আমরা তাদের পরিবেশ দিতে পারছি না। আর কয়েক দিনের ভিতরেই ফুটবল উন্মাদনা আমাদের দেশ থেকে উধাও হয়ে যাবে। কিন্তু এটি যেন না হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা যত ইনফাস্ট্রাকাচার সৃষ্টি করছি তার ভিতরে সেরা ইনফাস্ট্রাকাচার হতে হবে মানব সম্পদ। যত লজিস্ট্রিকস সৃষ্টি করছি সবচেয়ে গ্রেট লজিস্ট্রিকস হতে হবে মানবসম্পদ। 

সরকারের প্রতি আমাদের আহবান হলো, এই খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করুন। পৃথিবী আমাদের বিভিন্নভাবে চিনবে। তার ভিতরে সবচয়ে ভালো মাধ্যম হলো সংস্কৃতির সেক্টর। আমাদের সময় হয়েছে খেলাধুলা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিশ্বমানের প্রতিনিধি সৃষ্টি করার। সরকার যেন এই দিকে এবার একটু মনঃযোগ দেন। লেখক: কলামিস্ট