প্রকাশিত: Sun, Dec 3, 2023 1:50 AM
আপডেট: Fri, May 9, 2025 6:57 PM

ইমরান খানের পদত্যাগ: বাংলাদেশে বিএনপির শিক্ষণীয়

মাসুদ রানা, ফেসবুক: পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে কারাবন্দী নেতা ইমরান খান তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। আমি শিরোনামে বলতে চাইছি, বাংলাদেশের বিএনপি হয়তো বর্তমান পরিস্থিতে তারেক রহমানকে পদত্যাগ করাতে পারে।

বিষয়টি সবিস্তার বলার আগে আগে খানিকটা ভূমিকার প্রয়োজন আছে। আর, সে-ভূমিকাটি হবে তাত্ত্বিক - ডীপ স্টেইট নিয়ে। আমি ডীপ স্টেইটের  বাংলা নাম দিয়েছিলাম ‘গহীন রাষ্ট’।

বিশ্বের সব দেশেই ডীপ স্টেইট বা গহীন-রাষ্ট্র আছে। বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে নাগরিকগণ ভৌট দিয়ে সরকার তৈরি করে বলে বিশ্বাস করা হলেও,  মূলতঃ প্রতিটি দেশ পরিচালিত হয় গহীন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে।

গহীন রাষ্ট্র কী? গহীন রাষ্ট্র হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় সামরিক, প্রশাসনিক, বিচারিক ও ভূপতি-শিল্পপতি-বাণিজ্যপতির সাথে রাজনীতিকের সমন্বয়ে গঠিত একটি ইনফর্ম্যাল ক্লাব বা অনানুষ্ঠানিক সঙ্ঘ, যাদের যৌথ স্বার্থকে তারা দেশের স্বার্থ হিসেবে বিশ্বাস ও প্রচার করে রাষ্ট্রের কৌর্স অফ এ্যাকশন বা কর্মসূচি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে।

গহীন রাষ্ট্র যেমন এ্যামেরিকা-ব্রিটেইন-ফ্রান্স-রাশিয়া-চীন-তুর্কিয়া-ইরান-আরবে আছে, তেমনি ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-নেপাল-ভূটান-বার্মা-মালদ্বীপেও আছে। তবে, আমরা-যে রাষ্ট্র পরিচালনায় কথিত নির্বাচিত সরকার দেখি, তা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভৌট-পাওয়া প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত বলে মনে করা হলেও, তা বস্তুতঃ গহীন-রাষ্ট্রের দ্বারা পূর্ব-নির্ধারিত।

দেশে-দেশে গহীন-রাষ্ট্রের গহীনতার বিভিন্ন মাত্রার। বিশ্বের বনেদী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোতে গহীন-রাষ্ট্র সহসা জনদৃষ্টিতে আসে না। কারণ তাদের অদৃশ্যতার কলকৌশল সূক্ষ্ম ও সুদক্ষ। আর, অবনেদী ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে গহীন-রাষ্ট্র যথেষ্ট স্পষ্ট, এবং এমনকি উলঙ্গ।

১৮৬৩ সালে (১৯শে নভেম্বরের অপরাহ্নে), এ্যামেরিকার প্রেসিডেণ্ট এ্যাব্রাহাম লিঙ্কন-যে প্যানসিলভ্যানিয়ার গেটিসবার্গের কবরস্থানে  মৃতসৈনিকদের শ্রদ্ধাস্মরণের ভাষণে বলেছিলন মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব - অর্থাৎ জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার - তা নিতান্ত একটি সদিচ্ছা কিংবা তত্ত্ব হলেও, বাস্তবে জনগণের সরকার তথা রাষ্ট্র বলতে কোনো রাষ্ট্র কখনও ছিলো না, এখনও নেই। 

পাকিস্তানের গহীন-রাষ্ট্রটি যথেষ্ট উলঙ্গ - বিশেষতঃ এর সামরিক অঙ্গ। দেশটির রাজনীতিতে এবং প্রধানমন্ত্রীত্বে বিশ্ব-নন্দিত ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের উত্থান ও পতনের  হওয়ার পেছেনে পাকিস্তানী গহীন-রাষ্ট্রের উলঙ্গ ভূমিকা সর্বজনবিদিত।

বুঝে হোক, না বুঝে হোক, ইমরান খান গহীন-রাষ্ট্রের অবাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ, তিনি গহীন-রাষ্ট্রের মূল শক্তির সাথে রফা না করে এ্যামেরিকান ডীপ স্টেইটকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলেন রাশিয়ার সাথে সখ্য প্রদর্শন করে।

হতে পারে যে, ইমরান খান আসলেই দেশপ্রেমিক রাজনীতিক, আর সে-কারণে এ্যামেরিকান গহীন-রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে পাকিস্তানী গহীন-রাষ্ট্রের অধীনতামূলক মিত্রতা তিনি পছন্দ করেননি বলে বিকল্প হিসেবে রুশপন্থী হয়েছিলেন। আর, বিপত্তির শুরু সেখান থেকেই।

ইমরান খান বুঝতে পেরেছেন, পাকিস্তানের গহীন-রাষ্ট্র শুধু যে তাঁকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছে তা নয়, তাঁর দলটিকেও কবরে পাঠাবে। তাই, বুদ্ধিমান ও যৌক্তিক মানুষ ইমরান খান একটি কাজ করেছেন, যা ইতিহাসে বিরল। তিনি তাঁর স্বপ্রতিষ্ঠিত দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান পদ ত্যাগ করেছেন। তাঁকে স্থলাভিষিক্ত করতে তাঁর পরিবারর কোনো সদস্য আসেননি। দলটির নতুন প্রধান হয়েছেন তাঁর আইনজীবী ও ব্যারিস্টার গহর আলি খান।

ইমরান খানও পাকিস্তানের গহীন-রাষ্ট্রের অঙ্গ এলিট শ্রেণী থেকেই এসেছিলেন, কিন্তু অবাধ্য হওয়ার কারণে তাঁর শ্রেণীর লোকেরা - এমনকি দলের লোকেরা - তাঁকে ত্যাগ করেছেন। এমনও হতে পারে যে, এখনও পর্যন্ত যারা আছেন, তাদেরকে গহীন-রাষ্ট্রের সামরিক অঙ্গ স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে, ইমরান খানকে দলীয় চেয়ারম্যান রাখলে তোমাদের কোনো ভবিষ্যত নেই; আর সে-কারণেই হতো সমষ্টির স্বার্থে ইমরান খান পিটিআইর চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

আমার মনে হয় ইমরান খান যা করেছেন, তা বাংলাদেশে বিএনপির জন্য অনকরণীয় হতে পারে। অর্থাৎ, বিএনপির উচিত হবে তারেক রহমান তথা জিয়াউর রহমানের পারিবারিক দখলদারিত্ব থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের আসনকে মুক্ত করা। 

আমি মনে করি, বিএনপি এটি করতে পারলে, বাংলাদেশের গহীন রাষ্ট্রের কাছে তারা আবার গ্রহণীয় হয়ে উঠবে। কারণ, বাংলাদেশের গহীন-রাষ্ট্রে তৃপ্তিদায়ক মুখপাত্র শেখ হাসিনা, আর তাঁর কাছে চূড়ান্ত মাত্রায় অসহনীয় হচ্ছে জিয়াউর রহমানের পরিবার, যার মূলে আছে তাঁর এই বিশ্বাস যে, তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পেছেনে মূল ইন্ধনদাতা ছিলেন জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমান কিংবা তাঁর বিধবা খালেদা জিয়া এক সময়ে বাংলাদেশের গহীন-রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে থাকলেও, শেখ হাসিনা প্রচুর ছাড় দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজেকে স্বদেশী ও বিদেশী গহীন-রাষ্ট্রের কাছে নিজেকে শুধু গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করেননি, তিনি এর প্রধান অঙ্গ হয়ে উঠেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর পরিবার ও অনুগতদের প্রতিষ্ঠা করে। 

ফলে, জিয়া-পরিবারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সদস্যত্ব বাংলাদেশের গহীন-রাষ্ট্রের ক্লাবে আপাতঃ নিষিদ্ধ। তবে, আমি মনে করি না, বাংলাদেশের গহীন-রাষ্ট্র স্থায়ীভাবে বিএনপি-বিরোধী। এমনকি শেখ হাসিনাও নন।

এমন পরিস্থিতিতে, বিএনপির উচিত পাকিস্তানের পিটিআইর পদাঙ্ক অনুসরণ করা। অর্থাৎ, বিএনপির উচিত এর শীর্ষ নেতৃত্বে জিয়া-পরিবারের কাউকে না রাখা।  ইমরান খানের মতো তারেক রহমানও পদত্যাগ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলের অবস্থানকে সুসংহত হতে দেওয়া।

পরিশেষে, আমি মনে করি  বিএনপির নেতৃত্ব যদি পারিবারিক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে মুক্ত হতে পারে, তা আগামীতে আওয়ামী লীগের মধ্যেও অনুসৃত হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেবে। আর, এটি হলে বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ হবে - অর্থাৎ ডীপ স্টেইট বা গহীন-রাষ্ট্র সংযত হবে। 

অন্যথায়, হয়তো ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষমতায় আসার মতো বাংলাদেশে ইসলামবাদীরা আসবে - অর্থাৎ, গহীন-রাষ্ট্রের কাছে তার অধিক গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

০২/১২/২০২৩

লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড