প্রকাশিত: Tue, Dec 12, 2023 10:39 PM আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 12:10 AM
দুই সাবেক সেনাকর্মকর্তার ‘ডিগবাজি’ ও নির্বাচনী রাজনীতি
মাসুদ কামাল : নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিগবাজি দেওয়া দুই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নিজ নিজ কাজের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। শাহজাহান ওমর বলেছেন, উনি নাকি আগে থেকেই জয় বাংলার লোক। আর সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেছেন, রাস্তার পরিবর্তে উনি সংসদে গিয়ে কথা বলতে চান। দু’জনের এমন বক্তব্য কি দেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধকে বাড়িয়ে দেবে? এ নিয়েই এবারের আলোচনা।
এবারের নির্বাচন ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এতো নাটক হয়েছে, তার মধ্যে বড় দুটো নাটক হলো সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ও শাহজাহান ওমর। দু’জনই বীর মুক্তিযোদ্ধা। দু’জনই সামরিক বাহিনীর লোক। এর মধ্যে শাহজাহান ওমর সর্বোচ্চ পদকপ্রাপ্ত। তিনি বীরউত্তম পদক পেয়েছেন। এই দ’ুজন লোক এবার বড় আলোচনায় এসেছেন দুটো ডিগবাজির মাধ্যমে। একজন সরাসরি বিএনপিতে ছিলেন, আরেকজন বিএনপির জোটের সঙ্গে ছিলেন। তিনি একটি দলের প্রধান। তার নিজস্ব একটি দল আছে, কল্যাণপার্টি। তিনি সেই কল্যাণপার্টির প্রধান। সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম দলকে নিয়ে ডিগবাজি দিয়েছেন, আর শাহজাহান ওমর একা একা ডিগবাজি দিয়েছেন। শাহজাহান ওমরের ডিগবাজিটা একটু বড়। কারণ তিনি ডিগবাজি দিয়ে সরাসরি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে চলে গেছেন এবং আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। আর ইবরাহিম সাহেব আওয়ামী লীগে যাননি। তবে উনি নির্বাচনে যাচ্ছেন। এই নির্বাচন নিয়ে উনি যাদের সঙ্গে আন্দোলন করতেন তারা কেউই যাননি। উনি একাই গিয়েছেন। তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। কেউ তাদের মীর্জাফর বলেছেন, কেউ পেছন থেকে ছুড়ি মেরেছে বলে বিশেষণ দিয়েছেন। কিন্তু তার বিপরিতে উনারা কী বলেছেন! উনারা খণ্ড খণ্ড ভাবে অনেক কিছুই বলেছেন। তবে এর মধ্যে উনারা একটি ইন্টারভিউতে অনেক কথা বলেছেন। তার মধ্যে কিছু কথা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।
শাহজাহান ওমর বলেছেন, ‘আমি তো ব্যাসিক্যালি জয় বাংলার লোক। আমি ১৯৭১ সালে ‘জয় বাংলা’ বলে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতে আমার টিচার ছিলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে যখন রাজনীতি শুরু করেন, তখন আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁর দলে যুক্ত করেছিলেন।’ আমার প্রশ্ন হলো উনি যে জয় বাংলার লোক, এই কথাটি গত ৪৪-৪৫ বছরে বিএনপির নেতাদের জানিয়েছিলেন যে আমি মূলত জয় বাংলার লোক? ‘জয় বাংলা’টা খারাপ কিছু নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ‘জয় বাংলা’ আমাদের স্লোগান ছিল। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে নানা রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে ‘জয় বাংলা’ এখন একটা দলের স্লোগানে পরিণত হয়েছে। এটা যদি হয় তাহলে জয় বাংলার লোক হওয়াটাকে বিএনপি সহ্য করেছে? কীভাবে সহ্য করেছে? এটা আমার জানার খুব আগ্রহ। তিনি আরও বলেছেন, ‘আগে যখন আমি আওয়ামী লীগে যেতাম তখন তো আওয়ামী লীগে নেতৃত্বে সমস্যা ছিল। নেত্রী দেশে ছিলেন না। ১৯৯১ সালে আমি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করার জন্য গিয়েছিলাম। তখন তাদের মনোনয়ন আগেই ঠিক হয়ে যায় সে সময় আমি পাইনি।’
আমি উনার একথাটির অর্থ ঠিক বুঝলাম না। উনি ১৯৯১ সালে মনোনয়ন নিয়েছিলেন মানে এরশাদ পতনের পর। কিন্তু তখন আগেই মনোনয়ন ঠিক করে ফেলেছিল বলে উনি পাননি। তার মানে কি এখানে মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে কি রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো সম্পর্ক থাকতে হয় না? উনি কি মতাদর্শগতভাবে তখন বিএনপিতে ছিলেন না। উনি তো ৭৮ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। তাহলে ৯১ সালে উনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিতে গেলেন কীভাবে। এই বিষয়টি আমি ঠিক বুঝিনি। উনি কি সত্য বলছেন, নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলছেন? তখন যদি উনি মনোনয়নপত্র না নিতে পারেন এবারও তো মনোনয়ন পত্র দেওয়া হয়ে গিয়েছিলো আগে। উনি যোগ দেওয়ার আগে বিএম হারুনকে দিয়েছিলেন তাঁকে কেটে শাহজাহান ওমরকে দেওয়া হয়েছে বলে উনি দাবি করেছেন।
উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো এই যে কাজটি আপনি করলেন আন্দোলনরত বিএনপি থেকে চলে গেলেন, এটা কি বিএনপিকে পেছন থেকে ছুড়িকাঘাত করা হলো না? উনি বললেন, ‘না’। উনি নাকি বিএনপির নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে আগেই বিব্রত ছিলেন। উনি নাকি তারেক রহমানকে বলেছিলেন, আপনার এই হুমকি ধামকির ওপর দল চলে না। এই কথাটি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কারণ তারেক রহমানকে এরকম একটি কথা বলার পরেও উনি এতোদিন দলে ছিলেন, একথাটি আমার মনে হচ্ছে উনি বানিয়ে বানিয়ে বলেছেন। বিএনপির নেতারা নিশ্চয়ই এর কোনো একটি জবাব দিতে পারবেন।
অন্যদিকে সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম সাহেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনি কি লোভ-লালসার কারণে এই দলে এসেছেন’? তিনি বলেছেন, ‘কোনো প্রলোভন, লোভ-লালসা আমার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেনি। ২০১৪ সালে দাওয়াত গ্রহণ করে নির্বাচনে যেতে পারতাম, যাইনি। ২০১৮ সালে ২০-দলীয় জোট ত্যাগ করে সরকারি জোটে যেতে পারতাম, যাইনি। এবারও নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি।’ আমার কথা হলো আগের দু’বার যে যাননি তার লজিক কী? আর এবার যে গিয়েছেন তার লজিক কী? আপনি যখন একা থাকবেন তখন যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু যখন আপনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে যাবেন, একজন পাবলিক ফিগার হয়ে যাবেন তখন আমরা আপনার কাছে জবাবদিহি চাইতেই পারি। আপনি এখন ব্যাখ্যা দেন ২০১৪ এবং ১৮ সালে নির্বাচনে কেন যাননি, আর এখন কেন গিয়েছেন? আপনি একজন পাবলিক ফিগার যেকোনো পাবলিক আপনার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তরে আবার তিনি এক অদ্ভূত উত্তর দিয়েছিন। তিনি বলেছেন, ‘বিজয়নগর পানির ট্যাংকের মোড়ে দাঁড়িয়ে সপ্তাহে চারদিন পাঁচ মিনিট করে বলা আর সংসদে দাঁড়িয়ে বলায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।’
মানে উনি বলতে চেয়েছেন, এতোদিন উনি সপ্তাহে চারদিন বিজয়নগর পানির ট্যাংকের মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন, আর এখন উনি একটি সুযোগ পেয়েছেন সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন। আমার মতেও অবশ্যই পার্থক্য আছে। বিজয়নগর পানির ট্যাংকের মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন আপনি কথা বলবেন তখন আপনার আশেপাশে অনেক জনগণ থাকবে। কিন্তু আপনি যখন সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন তখন আপনার আশেপাশে কোনো জনগণ থাকবে না, সব এমপিরা থাকবে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, ‘আপনি কী করে জানলেন, আপনি সংসদে যাচ্ছেন?’ ‘আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে আপনি সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন?’ কক্সবাজার থেকে আপনি নির্বাচন করছেন সেটা আপনার এলাকাও না। ওখান থেকে আপনি কি করে জিতবেন? হ্যাঁ, ওখানের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে তার মানে কি এটা আপনার জন্য বরাদ্দ করা হলো আপনাকে সংসদে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য?
এরাই হলেন আমাদের দেশের সম্মানিত রাজনীতিবিদ। এরাই হলেন আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং পদকপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ। এরা আমাদের দেশের উদাহরণ। এদের কথা বললে আপনার গর্বে বুক ফুলে উঠবে? নাকি লজ্জায় মাথা নত হয়ে যাবে? এই সিদ্ধান্ত আপনাদের। পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। সূত্র : ‘কথা’ ফেসবুক চ্যানেলের ‘রাজনীতির কথা’ অনুষ্ঠান থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
