প্রকাশিত: Fri, Dec 29, 2023 10:47 PM
আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 7:07 PM

বাক্যই শব্দের অর্থ কী হবে তা ঠিক করে দেয়

গরীব নেওয়াজ : আমরা যখন বলি ঈ ঊ ঞ ণ য ষ ৎ-সহ আরও কতোক বর্ণ বাংলা ভাষাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, পুরো জাতিকে মূর্খ প্রতিপন্ন করছে; এগুলোর কারণে কেউ শুদ্ধ করে লিখতে পারে না, বলতে পারে না এবং ভাষাটা আধুনিকতা হতে পিছিয়ে পড়ছে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং সে কারণে এ বর্ণগুলো উঠিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তখন গোঁড়া পন্থিরা আমাদের বিরুদ্ধে উলঙ্গ ভাষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। কেউ-কেউ আবার কিছু উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এগুলোর কারণে সমোচ্চারিত শব্দের অর্থ পৃথক হয়ে যায় এবং সে কারণে এগুলো উঠিয়ে দিলে অর্থ বিভ্রাট হবে, ভাষার বৈচিত্র-সৌন্দর্য নষ্ট হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা হয় : পানি অর্থ জল, পাণি অর্থ হাত; দিন অর্থ দিবস, দ্বীন অর্থ দরিদ্র; আঁধার অর্থ অন্ধকার, আধার অর্থ পাত্র; দীপ অর্থ বাতি, দ্বীপ অর্থ হাতি; বেশি অর্থ অধিক, বেশী অর্থ বেশধারী; নীড় অর্থ পাখির বাসা, নীর অর্থ পানি; ভীত অর্থ শঙ্কিত/আতঙ্কিত, ভিত অর্থ বনিয়াদ ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, সমোচ্চারিত শব্দে বানান তারতম্যের জন্য শব্দের অর্থ পৃথক হয়ে যায়। এরকম আরও কিছু শব্দের উদাহরণ তারা দিয়ে থাকেন। তবে এক লক্ষ ৬০ হাজার, অন্যমতে চার লক্ষ বাংলা শব্দের মধ্যে এরকম শব্দের পরিমাণ হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। আর এর মধ্যে একটিই প্রধানত ব্যবহার হয়ে থাকে। অন্যটির অর্থ অধিকাংশ মানুষই জানেই না। যেমন সাধারণভাবে আমরা ‘পানি’ শব্দই ব্যবহার করে থাকি। ‘পাণি’ শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে।

সত্যি কি এসব বর্ণের কারণে সমোচ্চারিত শব্দের বানান ও অর্থের পার্থক্য সৃষ্টি হয় এবং এগুলো উঠিয়ে দিলে শব্দের বানান ও অর্থের বিভ্রান্তি হবে? এখন দেখা যাক, শব্দের অর্থ কার ওপর নির্ভর করে। ঈ ঊ ঞ ণ য ষ ইত্যাদির ওপর, না অন্য কিছুর ওপর নির্ভর করে। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ (ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) বইতে বলা হয়েছে, ‘শব্দের কোন্ অর্থ কোথায় তৈরি হবে, তা পুরো বাক্যটির উপর নির্ভর করে। বাক্যে ব্যবহৃত না হলে শব্দের অর্থ একটি বায়বীয় ধারণা মাত্র, বাক্যে ব্যবহার হলেই তার অর্থের সমস্ত সম্ভাবনার মধ্য থেকে একটি বা দুটি (দ্ব্যর্থকতার ক্ষেত্রে) অর্থ স্পষ্ট হয়। যেমন ‘এখন আমার হাত একদম খালি’। ‘হাত’ এখানে হাত বোঝাচ্ছে না যেমন, আবার ‘হাত খালি’ বলতে দুরকম অর্থ তৈরি হচ্ছে, ‘পয়সা নেই’ কিংবা ‘হাতে কোনো কাজ নেই’। কথা বলার প্রতিবেশ থেকে, কিংবা আশেপাশের বাক্য থেকে- হাত কথাটির অর্থ বুঝে নিতে হবে। ‘হাত খালি’র আক্ষরিক অর্থটা এখানে প্রধান রইলো না আর।’ (পৃষ্ঠা-৩০৭)।

আবার দেখুন, বিভিন্ন বাক্য কীভাবে ‘চাল’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ নির্ধারণ করে। যেমন : ঘরে চাল বাড়ন্ত, খাবে কী? ফুটো চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে; তার চালচলন মোটেই সুবিধার না; চালচুলোর ঠিক নেই, তোমাকে কে কে মেয়ে দেবে? সে কুটচাল দিতে পারদর্শী; দাবা খেলার শেষে সে ঘোড়ার চাল দিলো তাতেই কিস্তিমাত হলো। এভাবে চালচিত্র, চালকুমড়া, হালচাল, চালবাজ, চালপড়া, চালচিত্র ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে, একই বানানের ও উচ্চারণের ‘চাল’ শব্দটি বিভিন্ন বাক্যে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করছে। দেখুন ‘মাথা’ শব্দটি কতোভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। অঙ্কে তার মাথা নেই, সে মাথামোটা মানুষ, মেয়েটির মাথায় একরাশ চুল, তোমার কথার আগামাথা কিছু বুঝলাম না, আমার মাথায় অনেক বোঝা, এই রাস্তার মাথায় তার বাড়ি, এটা না করলে আমার মাথা খাও, রহিম মাতব্বর গ্রামের মাথা, সে মাথায় কিছু রাখতে পারেনা, ট্রেন ছাড়ার মাথায় সে স্টেশনে পৌঁছালো, সাত দিনের মাথায় সে ফিরে আসলো, সে সুটকেসটা মাথায় বয়ে আনলো ইত্যাদি। এভাবে মাথা ধরা, মাথা তোলা, মাথা কাটা, মাথা খারাপ করা, মাথা ঘামানো, মাথা খাটানো, মাথা গরম, মাথা গলানো, কাঁচা মাথা, মাথায় কাঁঠাল ভাঙা, মাথায় বজ্রাঘাত হওয়া, মাথার ওপর কেউ না থাকা, মাথা হেঁট করা ইত্যাদি। একই বানানে ও উচ্চারণে এরকম অসংখ্য শব্দ রয়েছে, যা ভিন্ন-ভিন্ন বাক্যে ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করছে। 

আবার যদি বলা হয়, ‘আপনি এই কাজটি করুন’, অথবা ‘সে করুণ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে’। এখানে করুন/করুণ শব্দ দুই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে ‘ন’ বা ‘ণ’ ব্যবহার করা হয়েছে তা মুখ্য নয়। কথা বলার সময় বলে দিচ্ছি না যে, এটা ‘ন’ দিয়ে আর এটা ‘ণ’ দিয়ে বলেছি। বাক্যই তার অর্থ ঠিক করে দিচ্ছে।

আরও বলতে হয়, যদি শব্দের অর্থের ভিন্নতার জন্য বেশি বর্ণের প্রয়োজন হয়, তাহলে শুধু ৫০টি নয় আরও বহু সংখ্যক বর্ণের প্রয়োজন আছে। ‘র’ এবং ‘ড়’ কমবেশি একইরকম উচ্চারণের বর্ণ। কাপড় পরার ক্ষেত্রে হবে ‘পরা’, আর বই পড়ার ক্ষেত্রে হবে ‘পড়া’। অর্থ ভিন্ন হওয়ার কারণে ‘পরা’ ও ‘পড়া’ লিখতে হচ্ছে। ভিন্ন-ভিন্ন বিষয় হওয়ায় ‘র’ এবং ‘ড়’ দুটি বর্ণই রাখতে হয়েছে। তাহলে বলতে হয়, কাপড় পরা এবং বই পড়া যেমন এক বিষয় না, তেমনি বই পড়া আর গাছ থেকে পড়া, মনে পড়া, ধরা পড়া, ডাকাত পড়া, মরচে পড়া, শুয়ে পড়া, অসুখে পড়া, শীত পড়া, বৃষ্টি পড়া, চুল পড়া, মন্ত্র পড়া, রাগ পড়া ইত্যাদি এক বিষয় না। এরকম আরও অনেক পড়া রয়েছে। প্রত্যেকটি পড়াই ভিন্ন-ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হচ্ছে।

 বর্ণ দিয়েই যদি শব্দের অর্থ নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে শুধু ‘র’ বা ‘ড়’ দিয়ে চলবে না, আরও বহু সংখ্যক র ড় ঢ় উচ্চারণের মতো বর্ণ তৈরি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে পড়া কতো রকম অর্থ প্রকাশ করতে পারে তা দেখালাম। আমি অবশ্য র ড় দুটোই রাখার পক্ষে। আমি ঢ় বাদ দেওয়ার কথা বলেছি। এ সম্পর্কে অন্যত্র বিস্তারিত লেখা রয়েছে। উল্লেখ্য ড় এবং ঢ় আদিতে বাংলা বর্ণমালায় যুক্ত ছিল না। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় এ দুটো বর্ণ বর্ণমালায় যুক্ত করা-সহ আরও কিছু সংস্কার করেছিলেন। আরও উল্লেখ্য সংস্কৃতে ড় ঢ় নেই। আর আমাদের সমস্ত মধ্যযুগ শুধু ‘র’ দিয়েই চলেছে। অর্থের ভিন্নতার কথা বলেই আমরা অনেকগুলো অতিরিক্ত বর্ণের বোঝা বইছি। উইকিপিডিয়ার তথ্যসূত্র অনুযায়ী কয়েকটি ভাষার মূলধ্বনী ও সেগুলোর বর্ণ সংখ্যা 

বাংলা ভাষার কী অপরাধ ছিলো যে, এ ভাষাকে ১৩টি বর্ণের অতিরিক্ত বোঝা বইতে হচ্ছে। এর আগে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে এক লেখায় দেখিয়েছি, বর্ণের সংজ্ঞা অনুযায়ী ৫০টি বর্ণের অনেকগুলো বাংলা ভাষার বর্ণই নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্ণ কী, বর্ণ কাকে বলে? প্রখ্যাত ভাষাবিদদের দেওয়া সূত্র অনুযায়ী ভাষার মূলে রয়েছে, মুখ দিয়ে উচ্চারিত অর্থপূর্ণ ধ্বনি বা ধ্বনি সমষ্টি। আর মুখের ধ্বনি প্রকাশের একক হচ্ছে বর্ণ। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ বইতে বলা হয়েছে, ‘মোটের উপর বাংলা ভাষা লেখার জন্য যে সমস্ত চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তারা প্রত্যেকে মৌখিক ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধ্বনি নির্দেশক চিহ্নগুলোকে বলা হয় বর্ণ (ষবঃঃবৎ)। (পৃষ্ঠা-১৩১)। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই সূত্র অনুযায়ী যে বর্ণ আমাদের মৌখিক ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করে অর্থাৎ মৌখিক ধ্বনির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সেটা আমাদের ভাষার বর্ণ, আর যে বর্ণ আমাদের মৌখিক ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব করে না সেটা আমাদের ভাষার বর্ণ হতে পারে না। মনে রাখা প্রয়োজন, কলমের নিব-এর আগা থেকে বর্ণ বা ভাষা মুখে আসেনি, মুখ থেকেই তা কলমে গিয়েছে।

বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের সংখ্যা ১১টি হলেও স্বরধ্বনির সংখ্যা ছয়টি অ আ ই উ এ ও। দেখা যাচ্ছে, ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ এই স্বরবর্ণগুলোর নিজস্ব কোনো ধ্বনি নেই। 

বাংলা ভাষার উচ্চারণ সবসময়ই হ্রস্বমাত্রার। একইভাবে ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ থাকলে ব্যঞ্জনধ্বনির সংখ্যা ৩০টি। ঞ য ণ ষ ৎ অনুস্বার বিসর্গ-এর নির্দিষ্ট বা নিজস্ব কোনো ধ্বনি নেই। ঢ়-এরও সরাসরি পৃথক উচ্চারণ নেই বললেই চলে। ড়-এর সঙ্গে ঢ়-এর উচ্চারণ সাধারণভাবে পৃথক করা যায় না। যেহেতু ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ ঞ য ণ ঢ় ষ ৎ অনুস্বার বিসর্গ বর্ণগুলোর নিজস্ব কোনো ধ্বনি নেই, আমাদের মৌখিক ধ্বনির প্রতিনিধিত্ব বা অনুসরণ করে না, সেহেতু সংজ্ঞা/সূত্র অনুসারে এগুলো আমাদের ভাষার বর্ণই নয়। উল্লেখ্য আন্তর্জাতিক বা বাংলা ধ্বনিলিপিতে এ বর্ণগুলোর হয় নির্দিষ্ট বা নিজস্ব কোনো ধ্বনি চিহ্ন নেই, অথবা সমোচ্চারিত বর্ণের ধ্বনি চিহ্নই এগুলোর ধ্বনি চিহ্ন। সংস্কৃতভাষা অনুসরণ করতে গিয়েই এগুলো রাখা হয়েছে যদিও বাংলা একটি স্বতন্ত্র ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষার কোনো উপভাষা নয়। এ বর্ণগুলো আমাদের ভাষার শরীরে টিউমার হয়ে বাসা বেঁধেছে। ফেসবুকে ২৭-১২-২৩ প্রকাশিত হয়েছে।