
প্রকাশিত: Sat, Jan 13, 2024 11:42 PM আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 7:12 PM
আনন্দবাজারকে আরবি নামের বানানই শুধু নয়, অর্থ বিশারদও হতে হবে বৈকি
তসলিমা নাসরিন, ফেসবুক: আনন্দবাজার চিরকাল মুসলমান নামের বানান থেকে আকার কেটে দিয়েছে, আহমদকে অহমদ লিখেছে, মোহাম্মদকে মহম্মদ লিখেছে, মোজাফফরকে মোজফফর লিখেছে, সালমান এফ রহমানকে সলমন এফ রহমান লিখেছে। এইবার দেখলাম আকার কাটার বদলে আকার জুড়েছে। এতকাল রশীদ খান বলে যাঁকে ডেকেছে, তাঁকে দিব্যি রাশিদ বলে ডাকছে। আর সারা বাংলা যাঁকে রশীদ বলতো, তাঁকে হঠাৎ রাশিদ রাশিদ করছে, খুব সচেতন ভাবে করছে, যেন আবার উচ্চারণে ভুল না হয়ে যায়, তাহলে তো ইজ্জত যাবে, হয়তো দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে যে এ তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিচ্ছু জানে না। আনন্দবাজার যে বানান লেখে সে বানানই সঠিক বানান, এ রকম একটি ধারণা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে চালু আছে। আমিও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বানান ফলো করি। কিন্তু জীবনে যাঁকে রশীদ নামে ডেকেছি, মরণে তাঁকে রাশিদ নামে ডাকবো না, এ আমার সিদ্ধান্ত।
বহু বছর আগে একবার আনন্দবাজারের এক সাংবাদিককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'বাঙালি মুসলমানদের নামের বানান বদলে দিচ্ছে কেন আনন্দবাজার?' তিনি উত্তরে বলেছিলেন, 'যেহেতু নামগুলো আরবি, সেহেতু সঠিক আরবি উচ্চারণের মতো বানানটা রাখা হচ্ছে।' আমি বলেছি, যার নাম, সে তার বানান যেভাবে লেখে সেভাবেই তো আপনাদের লেখা উচিত। আনন্দবাজারের সরকার আর পি সি সরকার তো তাঁদের সরকার বানান ইংরেজিতে দু রকম লেখেন। আমরা তো তাঁদের বানানই মেনে চলি। মুখার্জিরাও তাঁদের ইংরেজি বানান নানারকম ভাবে লেখেন। তাঁদের নামের বানান তো আমরা পাল্টাই না! আরবি শব্দ বহু বিবর্তনের পর বাঙালিরা যে ব্যবহার করছে, তা হুবুহু আরবি উচ্চারণের মতো আর নয়। ফেরদৌসের নাম যে আনন্দবাজার ফিরদাউস লিখছে, কেন লিখছে? ফেরদৌস বাঙালি, জন্মের পর থেকে সে তার নামের উচ্চারণ ফেরদৌস করছে, বাংলা বানানটাও ফেরদৌস। তার নামকে বদলে দেওয়ার অধিকার তো কারও থাকার কথা নয়। বহু আরবি ফার্সি শব্দ বাঙালিরা ব্যবহার করে, সেই সব শব্দ আরবরা এবং ফার্সিভাষীরা যেভাবে বলে, বাঙালিরা সেভাবে বলে না। বাঙালিরা যেভাবে বলে, বানানটাও সেভাবে লেখে। ইংরেজি যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, সেই সব ইংরেজি শব্দ ইংরেজরা যেভাবে বলে, সেভাবে বাঙালিরা বলে না। চেয়ার ইংরেজি শব্দ, ইংরেজরা চেয়ারকে চ্যার বলে, সে কারণে আমরা তো চেয়ারকে চ্যার লিখি না, টেবিলকে টেবল লিখি না। শব্দ এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে ভ্রমণ করতে করতে রূপ গুণ কিছু পাল্টায়, সেটা তো মনে রাখতে হবে।'
অনেকে বলছে উস্তাদ রশীদ খান বলতেন তিনি রশীদ নন, তিনি রাশীদ। আমার হিন্দি পাবলিশার অরুণ মাহেশ্বরিকে আমি যখন অরুণ বলে ডাকতাম, তিনি বলতেন, আমি অরুণ নই, আমি আরুণ। তাই বলে বাংলায় তাঁর নাম লিখলে আমি কি আরুণ লিখবো? লিখবো না। আমি অরুণই লিখবো। কারণ বাংলায় অরুণ শব্দটির একটি অর্থ আছে, আরুণ শব্দটির নেই। ইংরেজিতে আরুণ বানান এ আর ইউ এন লিখলেও কিন্তু এর বাংলা আমরা আরুণ করি না, অরুণ করি । আমি হিন্দিতে কথা বললে অরুণকে আরুণ বলি এখন, কিন্তু আমি যখন আমার বন্ধু অরুণ চক্রবর্তীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলি, আমি তাকে অরুণ বলে ডাকি। বাংলায় আমরা ওকার উচ্চারণ বেশি করি, সে কারণে আরবিতে রাশীদ বললেও বাংলায় সেটি রশীদ হয়ে ওঠে। রশীদ খান বাংলায় বাস করতেন, বাংলায় কথা বলতেন। অথচ তাঁর নামের বাংলা বানান নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেছে বাঙালির। রশীদের উচ্চারণ রাশীদ করতে ইচ্ছে হয় করুন, তবে করুন যখন আরবিতে বা উর্দুতে বা হিন্দিতে কথা বলবেন। কিন্তু বাংলায় শব্দটি বহু আগেই বিবর্তিত হয়ে রশীদ হয়েছে। বাংলায় রশীদই লিখতে হবে এবং বলতে হবে। আফগানিস্তানের ক্রিকেটারের নাম কিন্তু আনন্দবাজার রশীদ খান বা রশিদ খানই লিখছে , রাশিদ খান লিখছে না। সেই ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করুন, ক্রিকেটার বলবেন, তিনি রশীদ নন, তিনি রাশীদ। তাঁর নামের উচ্চারণ আফগান ভাষায় রাশীদ হলেও তিনি বাংলা ভাষায় রশীদ। বাংলায় আবদুর রশীদ শব্দটি গুগল করে দেখুন, কত লক্ষ আবদুর রশীদ বেরোয়। এই রশীদেরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে?এদের নামও তো আরবি শব্দ থেকে নেওয়া।
অনেকে ভাবছে রশীদ আর রাশীদের অর্থে পার্থক্য আছে, সে কারণে, রাশীদকে রশীদ ডাকা ঠিক হবে না। রশীদ আর রাশীদে কোনও পার্থক্য নেই। একই অর্থ দুটোর। রশীদ বা রাশীদ মানে সঠিক পথ প্রদর্শক। এই নামটি আল্লাহ'র নিরানব্বইটি নামের একটি। অন্য ধর্মের লোকেরা তাদের ঈশ্বর বা ভগবানের নামে নিজেদের নাম রাখতে পারে। কিন্তু ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহর নাম কোনও মানুষের নাম হতে পারে না। আল্লাহর নাম মানুষের জন্য রাখতে হলে নামের আগে আবদুল বা আবদুর যোগ করতে হবে। আবদুল বা আবদুর মানে দাস। তাহলে পুরো নামের অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর দাস। শুধু রশীদ খান কোনও মুসলমানের নাম হতে পারে না, হতে হবে আবদুল/আবদুর রশীদ খান। আনন্দবাজারকে শুধু আরবি নামের বানান বিশারদ হলে চলবে না, আরবি ভাষার অর্থ বিশারদও কিছু হতে হবে বৈকি।
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
