প্রকাশিত: Wed, Jan 17, 2024 11:44 AM
আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 5:53 PM

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে

আরশাদ মাহমুদ, ফেসবুক: প্রায় দুই সপ্তাহ খুলনা এবং উত্তরবঙ্গের সাতটি শহর ঘুরে সপ্তাহখানেক হলো ঢাকায় ফিরেছি।

এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল গত ৫০ বছরে দেশের সামগ্রিক অবস্থা স্বচক্ষে দেখা। কারণ উত্তরবঙ্গের শুধুমাত্র রংপুর আর বগুড়া ছাড়া স্বাধীনতার আগে আর কোথাও যাওয়া হয়নি।  রাজশাহীতে গিয়েছিলাম ১৯৭৪ এ।

ইতিমধ্যে আমি যেসব জায়গায় গিয়েছি তার কিছু বর্ণনা এবং ছবি পোস্ট করেছি। 

খুলনায় আমার গ্রামের বাড়িতে প্রায় আট দিন কাটিয়ে প্রথম যাই রাজশাহীতে ২৬ শে ডিসেম্বর। এরপর নাটোর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রংপুর এবং বগুড়া ভ্রমণ করি। যদিও অনেকটা ঝটিকা সফরের মত ছিল, তবুও চেষ্টা করেছি বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা বলা; তাদের ব্যক্তিগত মতামত জানা এবং দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া।

বলতে দ্বিধা নেই স্বচক্ষে যা দেখলাম তা ছিল কল্পনারও অতীত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি কলেজে পড়ি। সে সময় অভাব অনটন দেখেছি বিভিন্ন জায়গায়। আর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত।

সত্যি কথা বলতে কি স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সেরকম অভাব কোথাও চোখে পড়েনি।  সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি এককালের অবহেলিত উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ করে।

সেখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা প্রায় অধিকাংশ মানুষেরই আয়রোজগারের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণেই মঙ্গা নামক একটা ভয়াবহ অবস্থা ছিল তাদের জীবনের বাস্তবতা।

এখন শুধু যে রাস্তাঘাটের বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে তা নয়। এই সমগ্র এলাকা ঘুরে আমার মনে হল মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও অনেক, অনেক ভালো। দিনমজুর থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবার সঙ্গেই আলাপ করে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম অভাব আর তেমন একটা নেই কোথাও। সবাই মোটামুটি খেয়ে পরে ভালো আছে। 

সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের রাস্তাঘাট পাকা এবং মসৃণ দেখে। আর ভালো লাগলো কোথাও আগের মত কুঁড়েঘর বা কাঁচা বাড়ি চোখে পড়েনি। বিদ্যুৎ এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখতে পেলাম। সঙ্গে আছে মোবাইল ফোনের বিভিন্ন ছোট ছোট দোকান এবং ইন্টারনেট সেবার ব্যাপকতা। পঞ্চগড়ের একটা প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখতে পেলাম সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। 

প্রশ্ন হল এটা কি করে সম্ভব হয়েছে? 

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই গত ৫০ বছরে প্রতিটা সরকার গ্রাম উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে, বিশেষ করে নতুন রাস্তাঘাট তৈরি এবং গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যপক উন্নয়ন। অর্থাৎ ছোট ছোট, ব্রিজ কালভার্ট, হাট-বাজার, মসজিদ মন্দির ইত্যাদি। 

সে সঙ্গে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প, শিল্পকারখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার কারণে মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। বেকারত্ব প্রায় চোখেই পড়েনি। সবাই কিছু না কিছু করে খাচ্ছে। 

তবে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি আমার কাছে মনে হল একটা ইনফরমাল ইকনোমি গ্রো করেছে।  যেমন যে রাস্তার ধারে বসে চা, কলা বা সেদ্ধ ডিম বিক্রি করছে। এদের ব্যাংকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বা এদের ট্যাক্স আইডিও নেই। এ কারণেই বলেছি এই ইনফরমাল ইকোনোমির কথা। 

আর একটা বড় জনগোষ্ঠীকে দেখলাম তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে ইজিবাইক বা ব্যাটারী চালিত রিকশা চালিয়ে। যেখানেই গেছি সর্বত্রই দেখলাম এদের বিরাট উপস্থিতি। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার সব খরচ বাদ দিয়ে কিরকম টাকা প্রতিদিন থাকে। তিনি বললেন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। অর্থাৎ ৬০০ টাকা ধরলেও তার মাসে ইনকাম কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকার নিচে না। 

আর একটা বড় অংশ কৃষি কাজে নিয়োজিত এবং কৃষি পণ্য বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। সঙ্গে আছে মাছের চাষ এবং হাঁস-মুরগি, গরু পালন ইত্যাদি। 

এ প্রসঙ্গে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। খুলনায় আমার দুই ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী ঘরে বসে নিজেরাই ইনকাম করছে। একজন দেশি মুরগির ডিম বিক্রি করে। আর একজন তার স্বামীর দোকানে সিঙ্গারা বানিয়ে বিক্রি করে। তাদের দুজনকেই জিজ্ঞেস করলাম তোমরা এখন কেমন আছো। বললো ভালো আছি। কথায় কথায় জানলাম একটা সিঙ্গারা পাঁচ টাকায় বিক্রি করে এবং বেশ ভালো লাভ থাকে। মনে হল দুই থেকে আড়াই টাকা। আর এক ফুফাতো ভাইয়ের স্ত্রী বলল সে একটি মুরগির ডিম ১৫ টাকায় বিক্রি করে;  যেটা ঢাকাতেও আমি ১৫ টাকাতেই বিক্রি করতে দেখেছি।

আরেকটা জিনিস খুব চোখে পড়ল এবং সেটা নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন। ছোট-বড় যে কোন শহর বা শহরতলিতে দেখলাম অগুন্তি ডায়াগনস্টিক সেন্টর এবং ক্লিনিকের ছড়াছড়ি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এতে একটা বড় অংশের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু উদ্বিগ্ন হলাম এটা ভেবে যে মানুষের নিশ্চয়ই অসুখ- বিসুখ বেড়েছে ভীষণভাবে। না হলে এত ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রয়োজন টা কি। 

এ ব্যাপারে কথা হলো নাটোরে এক ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তার সঙ্গে। সে বলল ডাক্তারদের একটা বড় অংশ এখন এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা কারণে অকারণে বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে থাকেন এবং সেখান থেকে একটা পারসেন্টেজ পান। এটা অবশ্য কোন অজানা বিষয় নয়। তবে সরকার এদিকে একটু মনোযোগ দিলে মনে হয় দেশের মঙ্গলই হবে।

এই পোষ্টের শিরোনামেই যে কথা বলেছিলাম যে উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণ বঙ্গ সফরে কি দেখলাম ; কি বুঝলাম। 

যেটা দেখলাম সেটা তো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। যেটা বুঝলাম সেটা হল একবাক্যে বলতে পারি বাংলাদেশ এখন আর কোন গরিব দেশ নয়। এটা মোটামুটি একটা সচ্ছল এনটিটি। 

এ কারণেই বোধহয় মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ নেই। যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি তারা বললেন যে ঢাকায় কারা দেশ চালায় এটা নিয়ে আমাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ আমাদেরকে তো আমাদের নিজের এবং পরিবারের কথা ভাবতে হবে। সবাই বললেন আমরা চাই নির্ভয়ে যেন আমরা সন্ধ্যা বেলায় দিনের যে আয় রোজগার সেটা নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারি। 

সেটা অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে এটা হলফ করে বলতে পারছি না। কারণ একটা গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে যারা শাসক শ্রেণীর অনুগত। তারা কোন কাজকর্ম করে বলে মনে হলো না। এবং তাদের আয় রোজগারের প্রধান উৎস হলো চাঁদাবাজি এবং বিভিন্ন বেআইনি কাজকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা।  তারা ছোট ব্যবসায়ী, দোকানদার, ইজিবাইক এবং রিকশাচালকদের কাছ থেকে নিয়মিত একটা চাঁদা আদায় করে। অনেকেই বললেন সেটা করে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায়। এটা মনে হচ্ছে সারা বাংলাদেশেরই চিত্র।

এরাও কি ইনফরমাল ইকোনোমির অংশ? এ ব্যাপারে াবৎফরপঃ দেওয়ার মত গবেষণা আমার নেই। তবে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হচ্ছে যে ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন এবং অর্থনীতির উন্নয়ন কি একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত?

আর একটা কথা বলে শেষ করছি। আপনারা হয়তো জানেন আমি অনেকদিন বিদেশে ছিলাম। বিদেশে থাকার ফলে সত্যিকার অর্থে দেশকে সেভাবে জানার বা চেনার সুযোগ হয়নি এত বছরেও। যারা এখনো বিদেশে আছেন তাদেরকে বলবো সময় সুযোগ করে দেশে এসে একবার সার্বিক অবস্থাটা দেখেন। তাহলে হয়তো আমার মত আপনাদেরও দেশটার প্রতি এবং দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি মমতা এবং ভালোবাসা আরো বাড়বে। আমি যে বিদেশ থেকে চলে এসেছি তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কোন রিগ্রেট নেই। অন্যদিকে বলবো আমি আগের থেকে অনেক ভালো আছি।

নিজেকে এখন একজন গর্বিত বাঙালি এবং বাংলাদেশী মনে করি।