প্রকাশিত: Mon, Dec 26, 2022 3:33 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 4:48 PM

নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়?

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন

নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো আমাদের মূল শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আইটি, প্রযুক্তি, এসো কিছু করে খাওয়ার কাজ শিখি ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা জীবনেও উদ্ভাবনী জাতিতে পরিণত হতে পারবো না। উদ্ভাবনী দেশগুলোতে আমাদের কাছ থেকে এটাই চায় যেন আমরা তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বাজার হতে পারি। বিশাল ক্যানভাসে আমাদের সরকার এবং এই শিক্ষাক্রমের সাথে যারা জড়িত তারা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক ওইসব উদ্ভাবনী দেশের দালালে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান শেখার আগে আইটি, প্রযুক্তি ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া কারিগরি শিক্ষাক্রমের কাজ। সমাজের একটা বড় অংশকে এই শিক্ষা দিতে হবে। দেশকে যারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা ও উদ্ভাবনীতে এগিয়ে নিবে তাদের জন্য শিক্ষাক্রম হবে সেই শিক্ষার স্কুল কলেজে গুরুত্ব পাবে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, একাউন্টিং, বাংলা ভাষা, ইংরেজি, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ইত্যাদির মতো বিষয়। 

আমাদের নীতিনির্ধারকরা শ্রেণীকক্ষে পাঠদান মানে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, হোয়াইট বোর্ড ও মার্কার ব্যবহার ইত্যাদি বুঝি। মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে স্কুল লেভেলে যদি পাওয়ার পয়েন্টে লেকচার দেওয়া হয় তাতে ক্ষতি ছাড়া লাভ খুব কমই হবে। মাল্টিমিডিয়া থাকতে পারে। বিশেষ কিছু ছবি বা গ্রাফ ইত্যাদি দেখানোর জন্য থাকলে ভালো হয় কিন্তু আবশ্যিক নয়। এই শিক্ষাক্রমের ভালো দিক বলে যেটা চালানো হয়েছে সেটা হলো এসএসসি থেকে আগে যেই বিভাজন হতো সেটা আর থাকবে না। এইটা ভালো। কিন্তু যেইভাবে বিভাজন উঠিয়ে দেওয়া হলো তা মোটেই ভালো কিছু না। সবার জন্য সব আবশ্যিক করা মোটেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। এর মাধ্যমে শিক্ষার গড় মান কমিয়ে দেওয়া হলো। যেইটা করা উচিত ছিলো সেটা হলো কয়েকটি বিশেষ বিষয়কে আবশ্যিক করে (যেমন ভাষা, বাংলাদেশের ইতিহাস) বাকি সকল বিষয়কে অপশনাল করে দেওয়া। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ মতো বিষয় নির্বাচন করবে। এটাই করা হয় ইংল্যান্ডে যেটি আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা পড়ে। নতুন শিক্ষাক্রমের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো শিক্ষকদের দ্বারা কন্টিনুয়াস এসেসমেন্ট।

আমরা বাংলাদেশে যেই রাজনৈতিক আবহে বাস করি সেখানে এটি কতোটা কর্যকর হবে? শিক্ষকদের আর্থিকভাবে দুর্বল রাখলে তারা কতোটা স্বাধীনভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে? এই বেতনে যেই মানের শিক্ষক নিয়োগ দেই আমরা তারা কতোটা মূল্যায়নে সক্ষম হবে? এইসব কিছু না ভেবেই এই পদ্ধতি চালু করা ডিজাস্টার হবে। একই কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর কোনো সুফলতো পাইনি উল্টো শিক্ষার মানের ক্ষতি করেছে। একই অবস্থা চালু করলে। নিম্ন বেতনে নিম্নমানের শিক্ষকই পাওয়া যাবে। এই শিক্ষকরা কখনো মেরুদন্ড সোজা রাখতে পারবে না। আমাদের সরকারেরা এটাই চায় বলেই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে, শিক্ষকদের বেতন ভাতাদি বাড়ানোর উদ্যোগ কখনো নেয়নি। লেখাটি শেষ করছি আমার কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক বিমল সরকারের একটি পোস্ট থেকে একটি গল্পের মাধ্যমে। একবার এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য পরিদর্শনে বের হলেন। প্রথমে তাঁরা একটি জেলখানা পরিদর্শন করলেন। জেলখানার বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করার পর মুখ্যমন্ত্রী জেলারের কাছে জানতে চাইলেন, জেলখানার উন্নয়নের জন্য কতো টাকার অনুদান দরকার।

জেলার বললেন- স্যার, এখানে সব কিছু ঠিকঠাকই আছে। কোনো সাহায্যের এক্ষণে দরকার নেই। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, তবু আমরা যখন এসেছি, আপনি বলুন। জেলার কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে বললেন- আপনি যখন চাইছেন, তখন পাঁচ লাখ টাকা দেবেন স্যার। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সেটি নোট করে নিলেন। এরপর তারা একটি কলেজ পরিদর্শন করতে গেলেন। কলেজের বিভিন্ন অংশ পরিদর্শন করার পর মুখ্যমন্ত্রী অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করলেন, কলেজের উন্নয়নের জন্য কী পরিমাণ টাকার প্রয়োজন? অধ্যক্ষ কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন- স্যার, এই কলেজে শিক্ষকের অভাব আছে। ভবনসমূহের সংস্কার প্রয়োজন, উপযুক্ত ফার্নিচার নেই, ল্যাবরেটরির সব যন্ত্রপাতি নেই, লাইব্রেরির জন্য বই দরকার।

মুখ্যমন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বললেন, রাজকোষে বেশি টাকা নেই। ন্যূনতম কতো হলে চলবে সেটা বলুন। অধ্যক্ষ বললেন, কম করে হলেও পঞ্চাশ লাখ টাকা। মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সেটা নোট করে নিলেন। এরপর দুই নেতা রাজধানীতে ফিরে গেলেন। পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে বললেন, জেলখানাকে পঞ্চাশ লাখ আর কলেজকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য একটি আদেশপত্র বের করুন। অর্থমন্ত্রী অবাক হয়ে জানতে চাইলেন অনুদানের টাকার অঙ্ক উল্টে গেল কেন? মুখ্যমন্ত্রী বললেন, সে বুদ্ধি থাকলে আপনি আমার চেয়ারে বসতে পারতেন। অর্থমন্ত্রী বললেন, তার মানে? মুখ্যমন্ত্রী হেসে বললেন- দেখুন, ওই কলেজে আপনিও পড়তে যাবেন না, আমিও না। কিন্তু আমাদের যেকোনো সময়ে জেলখানায় যেতে হতে পারে। তাই জেলখানার পরিবেশটা একটুখানি আরামদায়ক করে রাখছি। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়