আহসান হাবিব : [১] ধরুন, বাংলাদেশের একজন উঠতি বুদ্ধিজীবী বললেন, তিনি ম্যারাডোনাকে চেনেন না, এই কথার মানে কী? তিনি কি আসলেই চেনেন না? চেনেন। আপনার চেয়ে ভালো চেনেন। তাহলে এটা বললেন কেন? কারণ এটা তার হীনমন্যতা। না চেনার ভান করে আসল কথাটা বলে ফেলেছেন। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ম্যারাডোনার মতো কালজয়ী না হতে পারার যে মনোবেদনা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তাকে না চেনার কথা ঘোষণা করে এই জ্বালা থেকে তিনি মুক্তি পেতে চাইলেন। পেলেন কি? না। আরো হীনমন্যতা। হায়! তাকে জেঁকে বসলো।

[২] আমাদের এই সময়ের একজন মহাবুজুর্গ বুদ্ধিজীবী বললেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের নখেরও যোগ্য নয়। মানে কী কথাটার? কাকে তিনি বড় করলেন, কাকে ছোট? স্পষ্টত এখানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছোট করতে চাইলেন। কার চেয়ে লালনের। তার মানে লালন বিশাল ব্যাপার, কিন্তু তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কেন? কারণ রবীন্দ্রনাথ এমনি বিশাল যে তাকে লালনের সাথে তুলনা করতেই হচ্ছে। তার মনস্তত্ত্বটা কী? লালনকে বড় করার চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করা। কারণ তিনি লালনকে সহ্য করলেও রবীন্দ্রনাথকে মোটেই সহ্য করতে পারছেন না। কিন্তু এখানে তার নিজের ছোটত্বের জ্বালা থেকে বাঁচতে রবীন্দ্রনাথকে টানায় তার সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ পেয়ে গেছে অজান্তেই। আসলে তিনি লালনকেও ধারণ করেন না এবং তিনি নিজে যে রবীন্দ্রের নখেরও যোগ্য নন, এই সত্যিটাই বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু তিনি কি তার এই মনোবেদনা থেকে মুক্তি পেলেন? পেলেন না বরং আরো অতলে তলিয়ে গেলেন।

[৩] এই মনোবিকলন অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা মানব মনস্তত্ত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এই সত্য মানুষ স্বীকার করতে চায় না। কারণ এই সত্য তাকে হেয় করে তোলে সমাজে। যেমন আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন। ফ্রয়েড যখন তার এই মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব হাজির করছিলেন, তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেম এই বলে যে এতে তার শত্রু বাড়বে। বেড়েওছিল। 

আমাদের এসব বুদ্ধিজীবীদের মনোজগত সাম্প্রদায়িকতায় আকীর্ণ। শিল্পকৃতি নয়, তাদের প্রধান মনোযোগ কে কোন ধর্মের। এরা যেহেতু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিভু, তাই সব ধর্মকে এরা সইতে পারবে, কিন্তু হিন্দু ধর্মকে কদাচ নয়। এর কারণ ঐতিহাসিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো হিন্দু নন, তাহলে তাকে নীচে নামানোর এই হীনমন্যতা কেন? কারণ তিনি ভারতীয়। হিন্দু বিরোধিতার ফলিত রূপ হচ্ছে ভারতবিরোধিতা। এই সাম্প্রদায়িক ভারতবিরোধী চেতনা এদের কুরে কুরে খাচ্ছে।

এরা মানুষ দেখতে পায় না, দেখে হিন্দু কিংবা মুসলিম, শিল্প তো দুরস্ত। লেখক: ঔপন্যাসিক