
প্রকাশিত: Mon, May 6, 2024 1:23 PM আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 12:53 AM
চিন্তাভীতি বনাম মুক্তচিন্তা
সিরাজ ইসলাম : অতীতকালে মানুষের লক্ষবছর লেগেছে পাথর ছুচালো করতে। এবং একটা স্ক্রু এমনকি ‘সামান্য’ চাকা আবিষ্কারেও লেগে গেছে বহু সহস্র বছর। নানাবিচারে সভ্যতার উন্নতি যে হয়েছে এমন বেদনাদায়ক ধীরগতিতে, মানুষের ভিতরে চিন্তাভীতি তথা মানসিক কুড়েমিই তার এক বড় কারণ। ভাবুককে পাগল বলে গালি দেয়া বাঙালি মুসলমানের মহৎ জাতীয় গুনাবলীর একটি। মুক্তচিন্তাপ্রিয় বা স্বশিক্ষিত ব্যতিক্রমীগোছের লোক আমাদের সমাজে হাস্যপরিহাসের পাত্র। কখনো তিনি অপদার্থ অমানুষ, কখনো পিতৃধর্মত্যাগী ঘৃণ্য পাষণ্ড নাস্তিক, আবার কখনো অবাস্তব তাত্ত্বিক, উদ্ভট দার্শনিক। তবে আগের দিনে ভাবুকের প্রতি সামাজিক দুর্ব্যবহার যেখানে হাসাহাসির অতিরিক্ত ইটপাটকেল ছুড়ত বড়জোর, সম্প্রতি সেখানে বুলিবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে গুলিবর্ষণও যুক্ত হয়েছে। যেদেশে মনের দিক দিয়ে মানুষ যতো স্থিতিজড় সেখানে ততো প্রকট এই প্রবণতা সুস্থকে অসুস্থ ভাবার। মনের দ্রোহ-দ্বান্দ্বিকতাই মুক্তচিন্তা। তা শ্রমসাপেক্ষ সক্রিয় ক্রিয়া। কুড়ে বলেই আমরা নি:সংশয় আনুগত্যপরায়ন। পূজাভক্তি ও বিশ্বাসপ্রবণ। আমরা অলস ‘সহজের’ গডডলিকা স্রোতে প্রবহমান। এক-অদ্বিতীয়মের আরাধনায় অনন্ত-অসীমের অভিমুখে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেয়ার বদলে কষ্টকল্পনায় বিকৃতরূপে-চিত্রিত নবী-অবতার, গ্রন্থ-কেতাব, গুরু-গুরুজন, মোড়ল-মুৎসুদ্দি এবং দেশি প্রভু ও বিদেশি প্রভাব প্রভৃতি নানান শক্তি, অপশক্তি, পরাশক্তি থেকে ক্রমশ পাঁজিপ্রথা, তন্ত্রমন্ত্র, তুকতাক এবং পানিপড়া ও তেলপড়া পর্যন্ত কতোকোটি উপ-অপ-দেবতার পায়ের পাদদেশে যে পদে পদে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে আমাদের ভীতি-বিহবল ভক্তমন!
ছোটবড় অগণিত কর্তার সম্মিলিত সর্বময় কর্তৃত্ব আমাদের আত্মকর্তৃত্বকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। মেনে নিয়ে মনেমনে আমরা এতোদূর ম্রিয়মান হয়ে আছি যে, সামান্যতম চিন্তাশ্রমেরও দায় এড়াতে এমনকি দুঃখের কঠিনতম পরীক্ষাতেও নিশ্চিন্তে চুপচাপ ভালোমানুষ হয়ে বসে থাকি। আমাদের চিরাচরিত বিচারে মুক্তচিন্তা প্রচলিত প্রথাবিরুদ্ধ। বিশ্বাস, বিবেক, সাধারণ জ্ঞান ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ। রুচি, নীতি ও শালীনতাবিরুদ্ধ। ঐতিহ্য, সংস্কার এবং গতানুগতিক নিয়মবিরুদ্ধ। সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রবিরুদ্ধ। তদুপরি মুক্তচিন্তা বেহুদা, কষ্টসাধ্য এবং সর্বোপরি আপদ ও অমঙ্গলজনক। একদিকে মানুষ উৎপত্তিগতভাবে চিন্তাশীল প্রাণী, চিন্তা তার সহজাত। যে অসমন্বিত দ্বন্দ্ব থেকে মানস-সরোবরে চিন্তা পাকিয়ে উঠতে থাকে বুদবুদের মতো, মানুষের চারদিকে সেই দ্বন্দ্ব অফুরন্ত। চিন্তা না করে তার উপায় নেই। অন্যদিকে তার চিন্তার সাবলীল প্রবাহকে পথেপথে বাধা দেয় মনের স্বার্থপর অন্ধতা ও আলস্য-জড়তার সঙ্গে সঙ্গে পৌত্তলিকতার অসংখ্য জগদ্দল পাথর। প্রাণের আসনকোণে সংগোপনে লুকিয়ে রাখা নানান এলোমেলো দেবতার শাসনত্রাসন। দেশাচার লোকাচার শাস্ত্রাচারের পীড়ন। অথচ মুক্তচিন্তা ছাড়াও মুক্তি নেই। মানুষের লক্ষবছরের প্রজ্ঞার সারকথা এই যে, আমরা যা ভাবি, যেকোনো বিষয়ই তারচে’ বহুগুণ জটিল। এই জটিলের অন্তর্ভেদ ও রহস্য-অনুসন্ধান-চেষ্টা মনুষ্যত্বের প্রথম পরিচয় এবং মানসিক উন্নতির প্রকৃত লক্ষণ। এজন্য ব্যতিক্রমী, ভাবুক, পাগলাটে, মহাক্ষ্যাপাদের সংখ্যা যেদেশে যতোবেশি, সেদেশ ততো আলোয় আলোকিত।
চিন্তা আর কিছুনা- মনের ভিতর দ্বন্দ্বের সমন্বয়চেষ্টা। যাকে পূর্বসংস্কার কখনো স্পর্শ করেনি, সেই স্বচ্ছ নির্মল শিশুমনের ন্যায় মন যখন মুক্ত, তখন প্রত্যেক নতুনের সাক্ষাতে তার মাঝে টানাহেচড়া লেগে যায়। নতুন দ্রষ্টব্য, শ্রব্য ও পাঠ্যবিষয় তার ভিতর ছোটবড় তোলপাড় তোলে নবনব জিজ্ঞাসাচিহ্নরূপে। নতুন গ্রন্থ, চিত্র, ঘটনা ও সংযোগ, নতুন বর্ণগন্ধধ্বনি, নতুন মতপথ- এইসব অসংখ্য নতুনের সংঘাতে মনের ভিতর আনাগোনা করা এই যে অসংখ্য অসমন্বিত দ্বন্দ্ব, সেসবের অবিশ্রান্ত সমন্বয়চেষ্টাই স্বাধীন মনের চিন্তাস্রোত। আলো, বাতাস, পানি প্রভৃতি যেসব প্রাকৃতিক সম্পদ জীবনের পক্ষে সর্বোচ্চ মূল্যবান, বাজারদরের হিসেবে সাধারণত সেগুলোই বিশেষ সস্তা। চিন্তাও তেমন। একদিকে যে-চিন্তা মানবমনের মহত্তম ক্রিয়া, যা বিশ্বজীবনের দীর্ঘ অভিব্যক্তির শ্রেষ্ঠ ফসল ও পদার্থের সর্বোচ্চ ব্যঞ্জনা, অমূল্য সেই চিন্তাই আবার অন্যদিকে সাধারণ পাঠাগারের তাকে অতি সুলভমূল্যে বহুদিন ধরে থরথরে সাজানো। সৌভাগ্যক্রমে আবার সেই চিন্তাসম্পদই কিনা আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রায় বিনামূল্যে আমাদের চারপাশে বিপুল হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে ব্যাপক মিডিয়া বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। চিন্তামণি অমূল্য হয়েও এতো যে সস্তা-সুলভ, তবু আমাদের ভিতরে চিন্তাভীতি চিন্তায় অনাগ্রহ প্রবল। আমাদের কাছে মুক্তচিন্তা জিনিসটা যে অহেতুক কাঠখোট্টা ছাড়াও প্রায়শ অচ্ছুত, আপত্তিকর ও এমনকি ভয়ঙ্কর, চিরাচরিত প্রথাবিশ্বাস ও সংস্কারের পিছুটান তার প্রধান কারণ। অবচেতনার গভীরে জেকে বসে থাকা এই প্রস্তরীভূত প্রাচীন জীবাশ্মগুলোকে একেএকে অস্ত্রোপচার করে পরিষ্কার করে ফেলা গেলে প্রতিদিনের প্রতিপার্শ্বের নিত্যনতুন অজস্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আমাদের মন আপনিই মুক্তচিন্তিত সহজ সৃজনশীলতায় ভরে উঠবে। চিন্তার এই সম্পূর্ণ মুক্তির ভিতর দিয়েই হবে অজ্ঞতার বন্দীশালা ভেঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সত্তার পুনরুত্থান। ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
