প্রকাশিত: Sat, May 11, 2024 1:44 PM
আপডেট: Sun, Jun 22, 2025 6:41 PM

পুঁজি যে মানুষকে ভোগের পেছনে ছোটা এক গাঁধা বানিয়ে দিয়েছে, সেখানে থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে

আহসান হাবিব : [১] মানুষ মনে করে ধর্মীয় নেতারা বুঝি তুলসী পাতায় ধোয়া নির্মল চরিত্রের অধিকারী একেকজন উন্নত মানুষ। আর আমাদের এখানে এখনো চরিত্রের নির্মলতাকে বিচার করা হয় যৌনতার নিরিখে। অর্থাৎ যৌনতার দিক থেকে যে যত একগামী, সে তত চরিত্রের দিক থেকে ফুলের মতো পবিত্র। কথাটা ডাহা ভুল। দেখা যায় যারা ধর্মকে সমালোচনা করে, তারা এইসব ধর্মীয় নেতাদের যৌনতার দিকগুলি তুলে ধরে তাদের চরিত্রে কলুষতা দিতে চায়। তারা মনে করে এতে করে মানুষ ধর্ম এবং ধর্মীয় নেতাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করবে এবং সেখান থেকে সরে আসলে আসতেও পারে। এই চিন্তাও মহাভুল। কী সঠিক? সঠিক হচ্ছে যে ধর্মনেতা যত বেশি যৌনতার দিক থেকে বহুগামী হবে, সে তত ধর্ম পালন করা লোকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে। যে যত বেশি নারীকে ভোগ করতে পারবে, সে তত বেশি বুজর্গ সাহসী প্রিয় নেতা হয়ে উঠবে। 

ইতিহাস বলছে, ধর্মীয় নেতারা যৌন আচরণে এক একজন বহুভোগ্য পুরুষ। তারা জানে এটা তাদের উম্মতদের জন্য প্রেরণাদায়ক কারণ ধর্মে নারীকে ভোগ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। শুধু ইহজগতে নয়, পরকালেও নারী ভোগ অফুরন্ত, যৌনতার ছড়াছড়ি। সুতরাং কোনো ধর্মীয় নেতার যৌনচরিত্রে বহুগামিতা দেখিয়ে তার জনপ্রিয়তা কমানো যাবে না একরতি বরং সেটাই তার গুন হয়ে তাদের কাছে দেখা দেবে এবং সেই লোভে ওই ধর্মীয় নেতার গলে মাল্য দেবে। নারীকে ভোগ করার ক্ষেত্রে যে নেতা যত দুর্ধর্ষ, সে তত জনপ্রিয়।

[২] আবার দেখুন সমাজে যে যত দুর্নীতিবাজ, সে তত বেশি শক্তিশালী এবং জনপ্রিয়। অথচ কিছু মানুষ মনে করে দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতি সম্পর্ক যত জানাজানি হবে, তত তার শক্তি এবং জনপ্রিয়তা কমবে। চিন্তাটা ডাহা ভুল। সমাজের সর্বস্তরে আমরা কি দেখি? দেখি মহা দুর্নীতিবাজ লোকটি সবচেয়ে শক্তিমান এবং জনপ্রিয় এবং শুধু তাই নয়, যে যত দুর্নীতিতে ক্ষমতাবান, সেই জনপ্রিয় নেতা এবং নির্বাচনে তারাই জয়ী হয়ে আসে। আসলে এই দুর্নীতিবাজ কারা? এরা প্রায়ই উৎপাদনের হালহাতিয়ারের মালিক, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তারা ভোগ করে কিংবা এরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠে। এই যে দুর্নীতিবাজ বলছি, আসলে তারাই সম্পদের মালিক। তারা সবকিছু কিনে নিতে পারে। ফলে তারা আইন আদালত নির্বাচন সব কিনে নেয়। যে যত বড় দুর্নীতিবাজ, সে তত বেশি এসব কিনতে পারে। সুতরাং কোনো নেতার বা সম্পদের মালিকের দুর্নীতির উদাহরণ দেখিয়ে তার ক্ষমতাকে নস্যাৎ করা যাবে বলে যারা ভাবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। বরং এটাই সত্য যে যত নীতিবান, দুর্নীতির আশ্রয় নেয় না, সে তত অনুকম্পার যোগ্য। দুর্নীতিতে যে যত বড়, সে তত ক্ষমতাবান নেতা।

[৩] পুঁজির চরিত্র কী? পৃথিবীর সবকিছুকে পণ্যে পরিণত করা। মানুষ থেকে প্রকৃতির যা কিছু আছে, সবকিছুকে সে নিজের দখলে নিয়ে পণ্য করে ফেলবে। জমি থেকে শুরু করে নদী সাগর বায়ু মহাবিশ্ব ধর্ম সব তার চাই। এমনকি ঐতিহ্য বলে যে একটা অহঙ্কারের বিষয় আছে, তাকেও সে পণ্যে রূপান্তরিত করে। যে ঐহিত্যের এই গুন নাই, তাকে সে ভাগাড়ে ফেলে দেয়। আর যাদের এই গুন আছে, তাদের চাকচিক্য করে আপনার সামনে তুলে ধরে পকেট থেকে পেনি খসিয়ে ফেলবে। আপনি একটি মাটির বানানো পুরনো চুল্লি দেখতে চান, কিংবা ঢেঁকিছাটা চাল, চলে যান যাদুঘরে, দেখার আগে শুধু পকেট থেকে ঝেড়ে ফেলুন কিছু মালকড়ি, ব্যস। অথচ আমাদের দেশে কিছু তথাকথিত ভাল মানুষ, প্রকৃতিপ্রেমিক আবেগে গলার রগ ফুলিয়ে এইসব প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের পণ্যে রূপান্তরিত হওয়া দেখে হাহাকার করে ওঠে। তারা ভাবে এই হাহাকারে পুঁজির হৃদয় গলবে, সে নদী, গাছপালা, হাওর, বিল, সাগর, মাঝিমাল্লার গান, গুণ টানার গান, ছাদ,পেটানোর গান, বিবিধ পিঠা, নবান্নের উৎসব এমনকি নববর্ষের হালখাতা ফিরিয়ে দেবে! দেবে না রে আহাম্মকের দল। তারা আরো আগ্রাসী হয়ে সবকিছু ছিনিয়ে বিক্রি করবে। তাতে এইসব টিকলো কি না, তা দেখার সময় তার নাই। তাহলে উপায়? পুঁজির লাগাম টেনে ধরা? না, ভোগের লাগাম টেনে ধরতে হবে। পুঁজি যে মানুষকে ভোগের পেছনে ছোটা এক গাঁধা বানিয়ে দিয়েছে, সেখানে থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে। কীভাবে? পুঁজিবাদী অর্থনীতির রূপান্তর করে। এটা আবেগী গলার রগ ফুলানো দিয়ে হবে না, লাগবে রাজনৈতিক সংগ্রাম যার লক্ষ্য একটাই- বিপ্লব। লেখক: ঔপন্যাসিক