প্রকাশিত: Sat, Dec 31, 2022 3:41 PM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 9:31 PM

সংকট শেষে সম্ভাবনার দিগন্ত রেখায় নতুন বছর

অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি

শুক্রবার মাঝরাতে সংসার ভাঙার ইঙ্গিত দিয়ে ফেসবুকে এক পোস্ট দিয়েছেন ঢাকার চলচ্চিত্রের এ নায়িকা। নিজের ফেসবুক আইডিতে রাত ১২টা ৪৩ মিনিটে দেওয়া এ পোস্টে পরীমনি লেখেন, ‘হ্যাপি থার্টিফার্স্ট এভরিওয়ান’! ‘আমি আজ রাজকে আমার জীবন থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম এবং নিজেকেও মুক্ত করলাম একটা অসুস্থ সম্পর্ক থেকে। জীবনে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকার থেকে জরুরি আর কিছুই নেই।’ নববর্ষের ঠিক আগের রাতে চমক দিলেন পরীমনি। অভিনয় বা ক্যারিয়ার যাই হোকÑ চমকে দেওয়ার বিষয়ে সবসময় অগ্রণী এই নায়িকা। এবারের নববর্ষের শুরুতে এই স্ট্যাটাস আবারও তাকে নিয়ে আসবে সংবাদ শিরোনামে। 

গেলো বছরের সালতামামি বেরুবে দৈনিকের পাতায়। মিডিয়াজুড়ে ঘুরে বেড়াবে গেলো বছরের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। এটাই নিয়ম। কলাম বা লেখার গতির সেদিকে পা না বাড়ানোই উত্তম। গেলো বছর ও বিশ্ব থেকে করোনার ভয় কাটেনি। এই অতিমারী স্বাভাবিক জীবনে বারবার হানা দিচ্ছে আততায়ীর মতো। কিন্তু জীবন চলমান। আর চলমান জীবনের ডানায় ভর করে পৃথিবী উদযাপন করেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। আমি মনে করি, গেলো বছরের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিলো এটি। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ বা জাতি ছিলো না যারা এই আনন্দে অবগাহন করেনি। ফুটবল প্রিয় বাঙালি বিশেষত: বাংলাদেশের মানুষজন আনন্দ উত্তেজনায় কাটিয়েছে সময়টুকু। ব্রাজিল জার্মানি ফ্রান্স বা মরক্কোর মতো দেশগুলো কেড়ে নিয়েছিল রাতের ঘুম। মধুরেণ সমাপেয়ৎ এর মতো শেষ হাসি হেসেছে বাংলাদেশের প্রিয়তম দল আর্জেন্টিনা। মেসির হাতে বিশ্বকাপ গেলবছরের শ্রেষ্ঠতম ঘটনাগুলোর একটি।

গেলো বছর বাংলাদেশের বড় দুই অর্জন ছিল চোখে পড়ার মতো। কতো বাধা, কতো বিপত্তি, কতো ষড়যন্ত্র। ...বন্ধ হবার মতো পরিস্থিতি। কথা দিয়ে কথা না রাখা বিদেশি সাহায্যের ধার না ধেরে শেষতক পদ্মা সেতু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আপনি পছন্দ করেন বা না করেন তাঁর মেধা আর সাহসেই সম্ভবপর হয়েছে এই কাজ। যা আজ বাংলাদেশের মাইল ফলক। যা তাঁকে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। বছরের শেষপ্রান্তে মেট্রোরেল আরেক চমক। এত কাল যা চিল অধরা স্বপ্ন তাকেই বাস্তবায়ন করে দেখালো বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার অদম্য মনোবল আর নেতৃত্বে এই কাজগুলো করতে পারার পরও গতবছর বিরোধী দলের রাজনীতি ভুলেও সরকার প্রধানের প্রশংসা বা ধন্যবাদ জানায় নি। গত বছর সরকারি দলও ছিল দমনে কঠোর আর বাকযুদ্ধে লিপ্ত । 

বাংলাদেশের সহিষ্ণু সমাজের ওপর আঘাত হেনেছিল টিপ বিতর্ক। সেও গেলো বছর। অধ্যাপিকা লতা সমাদ্দারকে টিপ পরায় হেনস্তা করা ঘটনাটি সারাদেশে এবং দেশের বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর স্বাভাবিক ভাবেই গর্জে উঠেছিল নারী সমাজ। কণ্ঠ মিলিয়ে প্রতিবাদী মুক্তমনের মানুষদের প্রতিরোধে ঘটনাটির হোতারা পিছটান দিতে বাধ্য হয়। তবে এই ঘটনা আশঙ্কার দুর্ভাবনা রেখে গেছে সমাজে। যেমনটি ঘটেছিল জিনস পরিহিতা তরুণীকে অপমান করার ভেতর। এই ধরনের পোশাক বা টিপ বিরোধী কাণ্ড মানুষ আগামী বছরে আর দেখতে চায় না ।  বাংলাদেশের ক্রিকেটের বড় অর্জন ছিল দুটি। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে জিততে জিততে কৌশলের কাছে হেরে যাওয়া এবং ওয়ান ডেতে ভারতকে হারানো। এই দুটি ঘটনা তারুণ্যকে শক্তি যোগবে বলে বিশ্বাস করি। আগেই বলেছি ঘটনা দুর্ঘটনায় বছর আসে বছর যায়। যেমন পেলেকে হারিয়ে কাঁদছে বিশ^। এমন শক্তিমান ফুটবলার আগে জন্মাননি। পরেও হাতে গোনা। আমরা বলছি আগামীর কথা। আমাদের দেশে বিজ্ঞান বিষয়টি নানা কূট কারণে আজ পিছিয়ে পড়েছে। একজন বিজ্ঞান টিচারকে অপমান করে কারাগারে প্রেরণ করা যেমন সত্য তেমনি প্রেরণার মতো জ্বলে উঠেছে সেঁজুতি সাহা । দুনিয়া নন্দিত লেনসেট বিজ্ঞান পত্রিকা তাকে সেরা দশ তরুণ তরুনীর ভেতর জায়গা করে দিয়েছে । তার গবেষণা ও মহামারী বিষয়ক কাজ আকৃষ্ট করেছে তাদের । নিঃসন্দেহে এ এক বিপুল অর্জন।  এখানেই বপন করা হোক বা বোপিত হোক আগামীর বীজ । 

নতুন বছর মানে কেবল থার্টিফাস্ট নাইট গান বাজনা কিংবা উদযাপনের হুল্লোড় নয়। বাংলাদেশের অর্জন ও সম্ভাবনা যখন হাতছানি দিচ্ছে তখন সমাজকে পেছন দিকে ঠেলে দেয়ার পথ বা অপচেষ্টা বন্ধ করে দিতে হবে। বিশ্বমানে এখন এই দেশটি আর হেলাফেলার দেশ না। রাজনীতির কঠিন পরিসংখ্যান এবং সমীকরণ অনেক সময় আমাদের ধাঁধায় ফেলে দিলেও মনে রাখতে হবে নতুন বছর যেন অপরাজনীতি বা নোংরা রাজনীতির শিকারে পরিণত না হয়। মেধা, শ্রম আর বিদেশের রেমিটেন্স মিলে যে স্বদেশ তার ফসল যেন ঘুনপোকা খেতে না পারে। অর্থ পাচার ও ব্যাংক লুটেরাদের চিরতরে বিদায় করা হোক আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি। সাথে এটাও বলব বিলেত বা অন্য দেশে বসে আমাদের মতো প্রবাসে থেকে দেশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও সঠিক নয়। দেশে থেকে দেশের মানুষের ভাষা ও আশা নিরাশার সঙ্গী হতে না পারলে বাগাড়ম্বর ব্যতীত আর কোনো লাভ হবে না । 

আমরা আফগানিস্তান হতে জন্মাইনি। গেলো বছর সেদেশে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সরকার । স্কুলেও নাকি যেতে দেবে না। কিন্তু তারা ভুলে গেছে ইরানে কি ঘটছে। নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যু ঘিরে ইরানে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ এখনো চলছে। সেই সঙ্গে চলছে বিক্ষোভ দমনের নামে ইরান সরকারের দমনপীড়ন। ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত নারী, শিশুসহ ৪৭৬ জন নিহত হয়েছেন। আটক হয়েছেন শিল্পী, সাহিত্যিকসহ কয়েকশ। বল প্রয়োগে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েছে ইরান। কয়েকজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে।

নারীশক্তির জাগরণ ব্যতীত কোনো দেশ এগোতে পারে না। পরিবারের মতো সমাজ বা দেশে ও নারীদের জাগরণ আর এগিয়ে আসা জরুরি। পাকিস্তানের সাথে এই কারণেই আমাদের আজ ব্যাপক তফাৎ। আমাদের মুদ্রা এখন তাদের রুপির দ্বিগুণের ও বেশি। এই সুস্থিরতা আর উন্নতির কান্ডারি একজন নারী। যিনি ক্রমেই পুরুষদের ছাপিয়ে হয়ে উঠেছেন রোল মডেল। আগামী বছরে বা নতুন বছরে বাংলাদেশে নারী শক্তির প্রভাব বাড়লে এবং তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। শেষ করব শিক্ষা ব্যবসহা র কথা দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশে এই খাতে উন্নয়নের পরিবর্তে নৈতিক অধঃপতনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। পোশাক পরিচ্ছদ সহ বিষয় নিয়েও চলছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র। অথচ পবিত্র কোরআন বা যেকোনো ধর্মগ্রন্থে এ কথাটা পরিষ্কার করে বলা হয়েছে বাড়াবাড়ি ভালো ফল বয়ে আনে না। শিক্ষা  যদি আধুনিক ও যুগোপযোগী না হয় তাহলে দেশের উন্নতি হতে পারে না। ২০২৩ সাল আশা ও সম্ভাবনার বছর হতে পারে এটা কেবল কথার কথা না। এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। বিশ্বব্যাপী মহামারীর ফলে যে কৃচ্ছতা সাধনের সংযমের লড়াই তাতে একাত্ম হয়ে আধুনিকতার চর্চা করলেই আমাদের সমাজের গতি বাড়বে। আমরা পৌঁছুতে পারবো আমাদের গন্তব্যে। শুভ নববর্ষ। লেখক ও  কলামিস্ট