প্রকাশিত: Sun, Jan 1, 2023 4:12 PM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 4:26 PM

অধ্যাপক আজিজুন্নাহারের বিরুদ্ধে আপনার আপত্তিটা কী?

ব্রাত্য রাইসু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুন্নাহার ইসলাম পরিবার, প্রেম ও বিয়ে সম্পর্কিত যে ইন্টারভিউ দিছেন, যা নিয়া তথাকথিত আধুনিক ভাবাপন্নরা বেশ ঠাট্টা মশকরা করতে আছেনÑতাতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। ঠাট্টায় দেখি, ইন্টারভিউতে দেখি না। যারা উনার সমালোচনা করতেছেন তাদের আর ওনার চাহিদা শেষমেশ একই। উভয় পক্ষই চান ‘একাধিক প্রেম’, ‘পরকীয়া’, ‘ঝগড়া’ ও ‘ডিভোর্স’হীন সুখী পরিবার। সুন্দর। তো আজিজুন্নাহার যা বলছেন সেগুলো পারিবারিক বন্ধন টিকাইয়া রাখনের প্রচলিত পন্থা। পরিবারের মধ্যে একাধিক প্রেম, পরকীয়া ও ঝগড়া না ঢুকতে দেওয়ার পরীক্ষিত পদ্ধতি। আপনারা জানেন, পরিবার নিজেই একটা প্রচলিত জিনিস। সেখানে তুলনায় কম প্রচলিত বিষয়েরÑ একাধিক প্রেম, পরকীয়া, অনৈতিক সম্পর্ক অবতারণা ঘটলে পারিবারিক সম্পর্ক অতি অবশ্যই সংকটে পতিত হবে। তো উনি ভুল কী বললেন?

২. উনি প্রেম নিয়া বলছেন। বলছেন যে প্রেমের সময় আবেগ কাজ করে, পরে আবেগ হারাইয়া যায়। ওনার কথায়, ‘বর্তমানে প্রেমের বিয়ে বেড়ে গেছে। প্রেম করার সময় আবেগ কাজ করে; কিন্তু বিয়ের পর বাস্তবতার মুখোমুখি হলে সেই আবেগ হারিয়ে যায়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেম করে বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে একাধিক প্রেমের সম্পর্ক থাকার কারণে বিয়ের পরও পরকীয়ার ঘটনা ঘটে চলেছে।’ এইখানে আপনারা ওনার কোন কথাটার বিরোধিতা করেন? আপনাদের নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা আছে যে প্রেমের বিয়াতে সমান অর্থনৈতিক অবস্থানের কারো সঙ্গে বিয়া হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অথচ মানুষ চায় বেটার অর্থনৈতিক অবস্থায় পৌঁছতে। যার কারণে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই আয় রোজগারে ঢুকতে হয়। এইটারে বাস্তবতা বলতে পারেন। বাস্তবতার চোটে তখন ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়।’

৩. কিন্তু পারিবারিক উদযোগে বিয়া হইলে অন্য ব্যাপার ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কী রকম? সেইটা হইল, আপনারা জানেন, পরিবারগুলো অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখতে গিয়া অর্থনৈতিক অবস্থান ওপরের দিকে লইয়া যাওয়ার জন্য মরিয়া হইয়া ওঠে এবং এর একটা সহজ মাধ্যম বিবাহ। পরিবারের মেয়েদের আরো বেশি বিত্তের ফ্যামিলিতে বিয়া দেওয়ার চেষ্টাটা সব অবস্থানের মানুষের জন্যই কমন একটা ঘটনা। কেউ তুলনায় কম টাকাপয়সা অলা ঘরে মেয়ে ছাড়ে না। অথচ প্রেমের বিয়াতে এই বাছাইটা নাই। যদিও অন্তত সমান বিত্তের নিচে মেয়েরা সাধারণত যাইতে চায় না; ছেলেরা অবশ্য মাঝে মাঝে যায়। পরিবারের মাধ্যমে বিবাহ ঘটলে মেয়েদের যতটা সংহতভাবে উচ্চ অর্থনীতিতে স্থানান্তর ঘটে প্রেমের বিয়ার মাধ্যমে সেই নিশ্চয়তা আসে না। তা পারিবারিক ব্যবস্থাপনার বিয়াতে বাস্তবতার সামনে কম পড়তে হয় মেয়েদের।

৪. কাজেই আপনাদের চাহিদা আর ড. আজিজুন্নাহার ইসলামের চাহিদা তো একই। বিয়ার মাধ্যমে বিত্ত অর্জন ও সুখী পরিবার গঠন। যদিও অভাবের সংসারে বা ছোটলোকের পরিবারে প্রেমের মাধ্যমে বিয়া না হইলেও পারিবারিকভাবে বিয়া হইলেও স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আমার মনে হয় না, সে ধরনের পরিবারের বিষয়ে আজিজুন্নাহার বা আপনারা আলাপ করতে আপাতত রাজি হইবেন। আলাপ মূলত মিডল ক্লাস ও তাদের মূল্যবোধ লইয়া। সুতরাং আপনারা একই রশুন। যারা ডিভোর্স, প্রেমের ভিন্ন রূপসমূহ (‘পরকীয়া’, ‘একাধিক প্রেম’, ‘অনৈতিক সম্পর্ক’) ও ঝগড়ারে মাইনা নিতে রাজি না। হিপোক্রিসিটা হইল, আপনারা নিজেরাও এগুলো করবেন, কিন্তু চাইবেন প্রচলিত পরিবারের নির্ঝঞ্ঝাট তরঙ্গহীন জীবন। তা কেমনে হবে? বরং অপ্রচলিত বা আপাত অসামাজিক জীবনের সংকটগুলোর লগে হয় মানাইয়া নিতে হবে, বা নাইলে আজিজুন্নাহার কথিত প্রচলিত পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে ঢুকতে হবে আপনাকে। একাধিক প্রেম বা পরকীয়া বা ডিভোর্স অত বড় সমস্যা না, যতটা বড় সমস্যা এইগুলো লইয়া ড. আজিজুন্নাহার ও আপনাদের আপত্তি। এই জিনিসগুলিরে মাইনা নিয়া কীভাবে নতুন ধরনের স্বল্পকালীন পরিবার পদ্ধতিতে নিজেরা ঢুকবেন ও সন্তানদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনবেন সেইটাই বরং আপনাদের ভাবা উচিত। 

৫. যারা নতুন ধরনের সামাজিক বাস্তবতায় ঢুকতে চান এই কথা তাদের বলতেছি। যারা প্রথাগত পরিবার চান তাদের জন্যে প্রেম, পরকীয়া, একাধিক প্রেম, ডিভোর্স এগুলো তো সমাধান অযোগ্য হবেই। পরকীয়া, অনৈতিক প্রেম, একাধিক প্রেম এগুলো সবই প্রেমের এক একটা রূপ। আপনারা চাইতেছেন বাকিগুলা না আসুক, খালি প্রেমই করবেন আর প্রেম কইরা পরে বিয়া করবেন এবং এর পরেই রোমান্টিক সম্পর্কের জগৎ থিকা পদত্যাগ করবেন! হাঃ হাঃ। তা কি হয় নাকি? প্রেম করার একটা অভ্যাস যখন আপনার হইছে সেই অভ্যাস সুপ্ত অবস্থায় আপনার ভিতরে থাকবে। কারণ আপনি সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা না মানার লুকোচুরিতে আগেই অভ্যস্ত হইয়া আছেন। সুতরাং সুযোগ পাইলে আপনার রোমান্টিকতা তার নতুন অ্যাকশন শুরু করবে। এইবার সামাজিক ও ধর্মীয় বাধার সঙ্গে যুক্ত হবে পার্টনারের বাধা। 

যেহেতু বাধা অতিক্রমের অভ্যাস আপনার আছে কাজেই নতুন বাধাও আপনি পার হইবেন এবং আবারও নবীন কোনো লুকোচুরিতে আপনি ঢুকবেন। পরকীয়া, একাধিক প্রেম, অনৈতিক প্রেম আপনার জন্যে অতো বাধার কিছু না যেহেতু। তাতে ধরা খাইলে ডিভোর্স হইতে পারে। আপনারা বেশি আধুনিক পরিবার হইলে বা নতুন সময়রে বুঝতে পারলে তা হয়তো হবে না। যেই কারণে একদা আপনি প্রেমে জড়াইছিলেন, সেই একই কারণে আপনি বাকিগুলোতেও পরকীয়া, একাধিক প্রেম ও অনৈতিক প্রেমে জড়াইতে পারেন। না জড়াইতে চাওয়ার অর্থ হইল ড. আজিজুন্নাহার যে পারিবারিক বন্ধনের ওকালতি করতেছেন আপনিও সেই পরিবার ও পরিবারের বন্ধনই আসলে চাইতেছেন। তাইলে ড. আজিজুন্নাহারের বিরুদ্ধে আপনার আপত্তিটা কী?

৬. তো আজিজুন্নাহার যেমন চান তেমন যদি আপনিও চান তাইলে আপনার জন্য আছে ধর্মজীবন, বাপমায়ের দেওয়া বিয়ার জীবন। ড. আজিজুন্নাহার ওই সত্যটাই সামনে তুইলা ধরছেন। আপনার চাহিদাটাই তার মুখ থিকা আসছে আর কী। তো ভালো। এখন বলেন, যেই পারিবারিক বন্ধন লোকলজ্জার দোহাই দিয়া এক লগে কারাগার বানাইয়া থাকতে বাধ্য করে আপনাদের, আপনারা তা মানতে চানই বা কেন! মনে রাখবেন, পরিবার বহু রকম। এক লগে থাকলেই কেবল পরিবার ঘটে না। কাল বদলাইছে। লেখক : কবি। ফেসবুক থেকে