
প্রকাশিত: Wed, Jan 4, 2023 4:19 PM আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 4:22 PM
তালেবানের নীতি গোঁড়ামি নাকি ইসলাম?
শামীমা আক্তার
সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। নারী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে বিক্ষোভের জেরে পাঁচ নারী শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে (২২ ডিসেম্বর)। দেশটিতে ইতোমধ্যে বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা বাদ পড়েছে। গত বছর আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান সহশিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। তালেবান ক্ষমতায় বসেই নারীদের জন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে দেওয়ার আশ^াস দিলেও বাস্তবে ঘটছে ঠিক উল্টো। তাদের কট্টরতা, বাড়াবাড়ি এবং গোঁড়ামির কারণে দেশটির অর্ধেক জনসংখ্যা হারাচ্ছে শিক্ষার সুযোগ।
১৯২০ সাল নাগাদ দেশের স্বার্থে নারী ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। তৎকালীন রাজা আমানুল্লাহ খান এক বিবাহ, নারী শিক্ষার প্রসার এবং আপাদমস্তক ঢাকা বোরখা তুলে দেওয়ার মতো পরিবর্তন আনেন। আফগানিস্তানে নারীরা ১৯৬৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবিধানিক সমতা লাভ করেছিল যা নব্বয়ের দশকে গৃহযুদ্ধের সময় তালেবানরা কেড়ে নিয়েছিল। ২০০১ সালের শেষের দিকে তালেবান শাসন অপসারণের পর নারীদের অধিকার ধীরে ধীরে উন্নত হয় এবং ২০০৪ সালের সংবিধানের অধীনে নারীরা আবারও পুরুষদের সমতুল্য মর্যাদা পায়।
২০২১ সালে তালিবানরা ক্ষমতায় এসে আবারও নারীদের ওপর অবরোধ প্রথা আরোপ করে। যে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের অধিকার বঞ্চিত করা হচ্ছে সেটা কোন ধর্ম? ইসলাম কি নারীদের অজ্ঞ, পশ্চাৎপদ, গৃহবন্দী করে রাখার কথা বলে, নাকি প্রগতির কথা বলে? তালেবানদের নীতি যদি ইসলাসম্মত হয়ে থাকে, তাহলে বিবেকবান মানুষমাত্রই স্বীকার করবেনÑ ইসলাম একটি পশ্চাৎমুখী, অজ্ঞতাপূর্ণ, জাহেলি জীবনব্যবস্থা (নাওযুবিল্লাহ) অথবা তালেবানরা একটি মনগড়া ধর্মের অনুসরণ করছে, যা ইসলামের নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আসুন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জেনে নিই, নারীদের বিষয়ে ইসলাম কী বলে।
আল্লাহ সর্বপ্রথম ‘পড়’ শব্দটি দিয়ে কোরআন অবতীর্ণ করা শুরু করেন (সুরা আলাক ১)। মূর্খ, অশিক্ষিত আরব জাতির অজ্ঞতা ও অন্ধত্বের শেকল চূর্ণ করতে ঘোষিত হয় এই ঐশ^রিক প্রত্যাদেশ, ‘জানো, বোঝো, উপলব্ধি কর, চোখ মেলে তাকাও, চিন্তা কর, তুমি আর দশটা পশুর মতো নও, তোমার মস্তিষ্ক অসাধারণ, তাকে কাজে লাগাও।’ এই একটি শব্দ ‘পড়’, একটি নবজাগরণের সংকল্প যা অচীরেই আরব জাতিকে বিশ্বের শিক্ষকের জাতিতে পরিণত করেছিল। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ শব্দটি (ইক্বরা,পড়) নিশ্চয় কেবল পুরুষদের জন্যই নাজেল হয়নি। আল্লাহর রসুলও জানতের এই শব্দটির মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়কেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তিনি তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য আব্যশ্যক বলেই আল্লাহ আমাদের তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন, রবিব যিদনী ইলমা ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও (সুরা ত্বোয়াহা ১১৪)।’
আমি সংক্ষেপে কয়েকটি হাদিস উপস্থাপন করছি। চিন্তাশীল মানুষদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট হবে বলে আশা করি। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘বিশ্বনবী বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরদ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকি)।’ রসুলাল্লাহ বলেন, ‘যার দুটি বা তিনটি কন্যাসন্তান আছে এবং তাদের উত্তম শিক্ষায় সুশিক্ষিত ও প্রতিপালিত করে সৎ পাত্রস্থ করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে সহাবস্থান করবে (মুসলিম)।’ জুবায়ের ইবনে মুতইম (রা.) বর্ণিত হাদিসে আছে, ‘একবার এক নারী রসুলের (সা.) দরবারে এসে কিছু বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করলো। বিদায় নিয়ে যাবার সময় রসুল (সা.) তাকে বললেন, আর জানার মতো কিছু থাকলে অন্য সময় জেনে নিও। নারীটি আরজ করলো, ইয়া রসুলাল্লাহ! যদি আপনাকে না পাই অর্থাৎ যদি আপনি দুনিয়াতে না থাকেন, তখন কী হবে? রসুল (সা.) বললেন, আবু বকরের নিকট তখন শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)। সুতরাং রসুল (সা.) স্বয়ং নারীদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বের করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলেন।
ইসলামের স্বর্ণযুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন এমন অনেক নারীই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ (রা.) আইন ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে এতটাই জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন যে, ওমর (রা.) তাকে ইসলামি আদালতের ‘ক্বাজাউল হাসাবাহ’ (অপপড়ঁহঃধনরষরঃু পড়ঁৎঃ) অর্থাৎ বিচারিক ব্যবস্থাপনা এবং ‘ক্বাজাউস সুক’ (গধৎশবঃ ধফসরহরংঃৎধঃরড়হ) অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। অথচ আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসলামের দোহাই দিয়ে নারীদের সর্বপ্রকার মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আফগানিস্তানে ধাত্রীদের মাধ্যমে প্রসব করানো হয়, পুরুষ চিকিৎসদের সেবা তারা নিতে পারে না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে কোনো নারীর মা হওয়ার জন্য বিশ্বে সবচেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্র আফগানিস্তান। অথচ রুফায়দাহ আসলামিয়া (রা.) ও অন্যান্য নারী সাহাবীরা তো আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে যুদ্ধাহত যেকোনো পুরুষ সাহাবিদেরই চিকিৎসা করতেন। রুফায়দাহ (রা.) ছিলেন প্রথম নারী মুসলিম সেবিকা হিসাবে স্বীকৃত একজন ইসলামি চিকিৎসক এবং সমাজ কর্মী (উইকিপিডিয়া)। রুফাইদাহ (রা.) আহতদের সেবায় মসজিদে একটি তাঁবু করেছিলেন। এছাড়া রসুলের (সা.) সমকালীন আরও কয়েকজন নারী চিকিৎসকদের মধ্যে উম্মে সিনান আল-ইসলামি, উম্মে মাতায়ী আল-আসলামিয়া এবং উম্মে ওরাকা বিনতে হারিস উলে¬খযোগ্য। মধ্যযুগেও মুসলিম নারীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার সাথে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ইবনে আল-জাওযী, ইবনে আল-খতীব বাগদাদী এবং ইবনে কাসীরসহ প্রমুখ ঐতিহাসিক দশম শতাব্দীর একজন নারী গণিতবিদের প্রশংসা করেছেন। সুতাইতা আল-মাহামালি নামের এই নারী গণিতবিদ গণিতের বিভিন্ন শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, একইসঙ্গে তিনি আরবি সাহিত্য, হাদিস এবং আইনশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
এভাবেই রসুলাল্লাহর তাঁর জাতির নারীদের প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন, তিনি কিন্তু নারীদের জন্য আলাদা কোনো শিক্ষালয়ের ব্যবস্থাও করেননি। তাঁর শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মসজিদে নববী। সেখানে নারী ও পুরুষ প্রত্যেকের অবাধ যাতায়াত ছিল। নারী-পুরুষ সকলে একসঙ্গে বসে রসুলাল্লাহর ভাষণ শুনেছেন, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা গ্রহণ করেছেন। মসজিদে নববীতে নারীদের জন্য পর্দা ঘেরা পৃথক কোনো বসার জায়গা রসুলাল্লাহ তৈরি করেননি, সাহাবিরাও করেননি। কিন্তু আজকে আফগানিস্তানে শুধু সহশিক্ষাই নিষিদ্ধ করেনি, গোটা শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই নারীদের বঞ্ছিত করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টিও কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন নারী, ফাতেমা আল ফিহরি। মরোক্কোর ফেজ শহরে ২৫৪ হিজরি সন মোতাবেক ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলিম-অমুসলিম শিক্ষার্থীগণ এখানে পড়তে আসতেন এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশুনা করে সনদলাভ করতেন। অথচ আফগানিস্তানের নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার পর্যন্ত নেই। সুতরাং, একটি বিষয় পরিষ্কার যে, তালেবান সরকারের গৃহীত আফগানিস্তানের নারীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার নীতি ইসলামের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক, এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো একটি উগ্র, পশ্চাৎমুখী, গোঁড়া শ্রেণির মতামতকে আল্লাহ-রাসুলের নামে চালিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ফেসবুক থেকে
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
