প্রকাশিত: Sun, Jan 8, 2023 2:57 PM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 11:49 AM

নতুন শিক্ষাক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন

নতুন শিক্ষাক্রমের উপর শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ের একটি ভিডিও দেখলাম। পুরো ভিডিওর সারাংশ হলো তারা নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে তৈরি করতে চায় যেন প্রতিটি সাবজেক্ট পড়ে জীবনভিত্তিক কিছু স্কিল অর্জন করে এবং বাস্তব জীবনে কিছু করতে পারে। আমাদের পুরোনো সিলেবাসে শুধু তত্ত্বীয় বিষয় শেখানো হতো এবং তাতে শিক্ষার্থীরা ওইসব শিক্ষা তাদের জীবনের সাথে মেলাতে পারতো না। এইসবই হলো নতুন শিক্ষাক্রম চালুর মূল উদ্যেশ্য। এই উদ্যেশ্যেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়ের উপর। নতুন এইসব বিষয় যোগ করা হয়েছে। এইজন্য যে জায়গা তৈরি করতে হবে সেই জায়গা তৈরির জন্য বিজ্ঞান ও গণিতকে বলি দেওয়া হয়েছে। আর কী করা হলো? আগে যে বিজ্ঞান,  কলা, ব্যবসা ইত্যাদিতে বিভাজন করা হতো তা তুলে দিয়ে সবাইকে এক কাতারে এনে সবাইকেই সব কিছু পড়তে বাধ্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যার যার ভালো লাগা, ইচ্ছা ও দুর্বলতা বিবেচনায় করে কলা, বিজ্ঞান, ব্যবসা ইত্যাদিতে ভাগ হয়ে যেতে পারতো। অর্থাৎ যার বিজ্ঞান ও গণিত পছন্দ নয় সে কলা কিংবা ব্যবসা পড়তে পারতো। আর যার বিজ্ঞান ও গণিত ভালো লাগে সে বিজ্ঞান পড়তে পারতো। এখন এইটুকু স্বাধীনতাও হরণ করা হয়েছে। যেইসব দেশ যেমন ইংলেন্ডে নবম শ্রেণীতেই বিভাজন করা হয় না। না করে বিশাল লম্বা একটা লিস্টের, যেখানে সংগীত, নৃত্য, চারুকলাসহ সকল সাবজেক্ট উম্মুক্ত করে দেওয়া আছে। যে যার পছন্দমতো স্বাধীনভাবে পছন্দ করতে পারে। দুই দিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম কিছু সো কলড বিশেষজ্ঞদের ডেকে নতুন শিক্ষাক্রমের গুণগান গাওয়া হচ্ছে। একটি আলোচনার জন্য দরকার বিপরীত চিন্তার মানুষদের এনে একটি সুস্থ আলোচনার ব্যবস্থা করা যাতে, জনগণ সম্পূর্ণ স্পেকট্রামটা জানতে পারে। তোষামোদি মার্কা আলোচনা এখন সব বিষয়ে সর্বত্র।  

জীবনভিত্তিক শিক্ষা যেমন জীবন ও জীবিকা, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি স্কুল কাররিকুলামে ঢুকানো হলো যেন এসএসসি শেষেই কেউ কিছু করে খেতে পারার স্কিল অর্জন করতে পারে। শিক্ষার অনেকগুলো ব্রাঞ্চ আমাদের দেশেই আছে যেমন কারিগরি শিক্ষা, ভোকেশনাল শিক্ষা যার মূল উদ্যেশ্যই হলো সেই স্কুল বা কলেজ শিক্ষা শেষেই কিছু করে খেতে পারে। এইটা তো মূল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না। শিক্ষার্থীরা এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় পাস করে যারা কিছু করে জীবন যুদ্ধে নামবে তাদের জন্য  তো কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা আছে। মূল শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষায় নামানোতো একটা গর্হিত কাজ। মূল শিক্ষার সপ্তম শ্রেণিতে দেখলাম এখন শেখানো হবে কীভাবে ডাল রান্না করবে, সবজি রান্না করবে, মাছ রান্না করবে। এইসব কি স্কুলের পাঠ্য বই পড়ে শেখার বিষয়? একটি দেশের শিক্ষার মূল ধারার উদ্যেশ্যতো হবে সুদূর প্রসারী। মূল শিক্ষাক্রমের মূল উদ্যেশ্য হবে বড় বিজ্ঞানী বানানোর, বড় ইঞ্জিনিয়ার বানানোর, বড় ডাক্তার বানানোর, বড় বিজ্ঞানী বানানোর, বড় দার্শনিক বানানোর, বড় অর্থনীতিবিদ বানানোর। মূল কাররিকুলাম তো কিছু স্কিল শেখানোর উদ্দেশ্য হতে পারে না। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রযুক্তি নামে একটি বিষয় স্কুল লেভেলের সকল শ্রেণীতে দেওয়ার অর্থ হলো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। বিজ্ঞানের সাথেও প্রযুক্তি জুড়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানের ছাত্ররা যে আগে উচ্চতর গণিত নামে একটি বিষয় পড়তো সেটা সম্পূর্ণ উঠিয়ে দেওয়া হলো আর পদার্থবিজ্ঞান, জীবনবিজ্ঞান ও রসায়নকে একসাথে করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নামে একটি বিষয়ে পড়ানো হলো। এই তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব কমিয়ে এক চিমটি পদার্থ বিজ্ঞান, এক চিমটি রসায়ন, এক চিমটি জীববিজ্ঞান পড়িয়ে আমরা সামনে এগোবো নাকি আমাদের শিক্ষার মানকে পিছিয়ে দিবে? তারপর আবার জীবন ও জীবিকা নামে একটি বিষয় দেওয়া হলো। এইটা তো পুরোপুরি কারিগরি শাখার বিষয় হওয়ার কথা। এটিকে কীভাবে মূল শিক্ষাক্রমে জুড়ে দেওয়া হলো? 

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলোÑ [১] ভাষা ও যোগাযোগ, [২] গণিত ও যুক্তি, [৩] জীবন ও জীবিকা, [৪] সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, [৫] পরিবেশ ও জলবায়ু, [৬] বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, [৭] তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, [৮] শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, [৯] মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং [১০] শিল্প ও সংস্কৃতি। এখন একই দেশে যারা ইংরেজি মাধ্যম পড়বে তারা উচ্চতর গণিত শিখবে যেটি আগে আমাদের সিলেবাসে ছিল এখন একদম উঠিয়ে দেওয়া হলো। এখন একই দেশে যারা ইংরেজি মাধ্যম পড়বে তারা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান আলাদা বিষয় হিসাবে পড়বে। নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা কিভাবে ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠবে? নাকি যেন না পারে সেটাই নতুন শিক্ষাক্রম চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য? 

আমরা চতুর্থ বিল্পবের কথা বলছি। ১৭৬০ সালের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিন দিয়ে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটে যদিও ১৭১২ সালে স্টিম ইঞ্জিন প্রথম বানানো হয়। এর মাধ্যমে তৈরি হয় শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। অথচ তখন মানুষ ভেবেছিল ইঞ্জিন দিয়ে কাজ করালে অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাবে। আগামীর ১৮৭০ সাল থেকে ইলেকট্রিক ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয় প্রযুক্তিগত দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। রেলপথ, টেলিফোন ও বিদ্যুতের আবিষ্কার সে বিপ্লবের সময় হয়। এরপর একেক্ট্রনিক্সের আবিষ্কারের মাধ্যমে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এখন রোবোটিক্স এবং অও এর মাধ্যমে শুরু হতে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। কোন বিল্পবই বেকার তৈরী করেনি বরং কর্মসংস্থান বাড়িয়েছে। প্রতিটি বিল্পবের সুফল তারাই ঘরে তুলতে পেরেছে যারা গবেষনা ও উদ্ভাবনীতে এগিয়ে গিয়েছে। যারা গবেষণা ও উদ্ভাবনীতে সংযুক্ত থাকতে পারেনি তারা কেবল অন্যদের বাজারে পরিণত হয়েছে। তারা কেবল কায়িক পরিশ্রমের জন্য কর্মী তৈরী করেছে। প্রশ্ন হলো আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম কি গবেষক ও উদ্ভাবক তৈরির সহায়ক হবে? বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তি শিখে কেবল টেকনিসিয়ান হওয়া যায় গবেষক বা উদ্ভাবক হওয়া যায় না। এই কথাটি আমি আগেও অনেকবার বলেছি এবং এখন আরো জোর দিয়ে বলছি। 

আমরা কি তবে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী পাঠিয়ে রেমিটেন্স বাড়ানোর উদ্যেশ্যেই এই নতুন শিক্ষাক্রম চালু করছি? কারণ এই কাররিকুলাম পড়ে বড় অর্থনীতিবিদ, বড় বিজ্ঞানী, বড় দার্শনিক, বড় গবেষক বানাতে পারবো না। এই শিক্ষার মাধ্যমে গণিত অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ইত্যাদি অলিম্পিয়াডে ভালো করার মত শিক্ষার্থী তৈরী করতে পারব না। এইটা আমরা কিছুদিনের মধ্যেই টের পাব। 

একটি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হবে যেন রাষ্ট্র চালাতে নানা বিষয়ে শিক্ষিত জনবলের দরকার হয়। তবে একটি সত্যিকারের উন্নত হওয়ার জন্য দরকার আইনস্টাইন, অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমিতাভ ঘোষ, অধ্যাপক জাহিদ হাসানদের মত কিছু বিশ্বমানের স্কলার, সাহিত্যিক, দার্শনিক। ব্রেইনের যেমন মোট নিউরণের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ হাবের মত কাজ করে পুরো ব্রেইন নেটওয়ার্ক এর কার্যক্ষমতা অসাধারণ বানায় তেমনি একটি রাষ্ট্রের মোট জনগুষ্টির খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ হবে বিশ্বমানের চিন্তক, গবেষক, দার্শনিক, সাহিত্যিক। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এই শিক্ষাক্রম পড়ে এই রাষ্ট্র বিশ্বমানের স্কলার তৈরী করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে। আমি যতটুকু খোঁজ নিয়ে জেনেছি এই শিক্ষাক্রম তৈরীতে যারা যুক্ত ছিলেন বা আছেন তাদের বেশিরভাগই প্রযুক্তিবিদ যাদের অনেকেই আবার একই সাথে তোষামোদকারী। এরা দেখেছে কি করিলে প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা যায়। এদের বেশিরভাগ প্রযুক্তিবিদ হওয়ার ফলে এদের মাথায় কেবল কিছু করে খাওয়ার চিন্তাই আসে। এই শিক্ষাক্রম চালু হলে উচ্চবিত্তের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ তাদের জন্য সান্টিংয়ের ব্যবস্থা বা বিকল্প ব্যবস্থা আছে। সেটা হলো ইংরেজি মাধ্যম। ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষেরা। দেশে ধনী গরিবের ব্যবধান বাড়বে। দেশে ক্লাস বিভাজন বাড়বে। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়